কমলিকা সেনগুপ্ত
#নন্দীগ্রাম: সময়ের ব্যবধান মাত্র বছরখানেক! প্রায় এই সময়েই, ঠিক এক বছর আগে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনকে (West Bengal Legislative Assembly Elections 2021) কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল রাজ্যের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়া সাবডিভিশনের এক এলাকা। সারা দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে তখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে উঠেছে নন্দীগ্রাম (Nandigram), হোক না সে সেন্সাস টাউন, তার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত থেকে তখন আগুন ঝরছে। কার দখলে থাকবে এলাকা- এই নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে। একদিকে নন্দীগ্রাম থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন খোদ রাজ্যের মুখ্যন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee); অন্য দিকে রয়েছেন তাঁরই দল তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) ছেড়ে ভারতীয় জনতা পার্টিতে (BJP) সদ্য যোগ দেওয়া শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikary)।
সেবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হেরে গিয়েও ফের ফিরে এসেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদে। শুভেন্দু অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন নন্দীগ্রামের মুখ, বিধায়ক তো বটেই! কিন্তু নন্দীগ্রামের দখল নিয়ে চাপান-উতোর এখানেই থামেনি। নির্বাচনের ফল ঘোষণা হওয়ার পরে খুন হয়েছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির এক সদস্য। তার পর? সেই হত্যার বছর ঘুরে যাওয়ার পরে কেমন আছে নন্দীগ্রাম? ঘুরে দেখল নিউজ১৮ (News18)।
পতাকার লড়াই
নন্দীগ্রামে পা ফেলে হাজির হওয়া যাক রায়পাড়া বাজারে, সেখান থেকে নন্দীগ্রাম বাজার পর্যন্ত আপাতত পায়চারির পরিসর। এই পথ এখনও পতাকায় ঢাকা; পথের এ-প্রান্ত থেকে সে-প্রান্ত ঢেকে আছে গেরুয়া আর সবুজ পতাকায়, কোথাও শতদল-বিলাস, কোথাও বা আবার ঘাসের ফুলের উচ্ছ্বাস- তৃণমূল কংগ্রেস হোক বা ভারতীয় জনতা পার্টি- কেউই নন্দীগ্রাম নিয়ে আপোস রফায় রাজি নয়, লড়াই এখনও চলছে।
আরও পড়ুন: 'মানুষ সব দেখছে...’ রাজ্যপালকে ট্যুইট-বাণ অভিষেকের, ‘সীমারেখা' তরজা তুঙ্গে!
নিউজ18 এই পতাকার প্রসঙ্গে কথা বলেছে এক স্থানীয় চাওয়ালার সঙ্গে। "রাজনৈতিক পরিস্থিতি নন্দীগ্রামে সব সময়েই উত্তপ্ত হয়ে থাকে। সব দলই এখানে নিজের আধিপত্য কায়েম করতে চায়, ওই পতাকা দেখে বুঝতে পারছেন না? গত কয়েক মাস ধরে এই তো চলছে; কে জানে ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য", বলছেন মন্টু মাঝি।
চিলাগ্রাম পেরোতেই নিউজ১৮-এর চোখে পড়ল শহিদ দেবব্রত মাইতির (Debabrata Maity) এক মূর্তি, দেখে মনে হয় মূর্তিটা যেন খুব বেশি দিন সেখানে বসানো হয়নি। ২০২১ সালের ২ মে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে শাসক দলের তরফে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ!
অবশ্য়, দেবব্রত একা নন, ২০০৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রাজনীতির পাকেচক্রে প্রাণ গিয়েছে নন্দীগ্রামের অনেক বাসিন্দারই! স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দেবব্রতর ওই মূর্তি ওখানে স্থাপিত হয়েছে বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারীর উদ্যোগে।
মাইতির বাড়ির অবস্থা এখন কীরকম? দেবব্রতর বাড়ির কাছে গিয়ে নিউজ১৮ দেখেছে, আদালতের নির্দেশ অনুসারে এখনও সেখানে পাঁচজন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (Central Reserve Police Force) সশস্ত্র সদস্য সুরক্ষায় মোতায়েন রয়েছেন।"আমাদের এখনও বিশ্বাস হয় না যে উনি আর জীবিত নেই! গত এক বছর ধরে আমরা ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করে চলেছি, কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোনও সাড়া পাইনি। এর মাঝে গত ছয় মাস ধরে আমাদের আর কোনও বিব্রতজনক অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়নি ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে কী হবে তা খুব একটা জোর দিয়ে বলা যায় না। আমরা শুভেন্দু অধিকারীর কাছে কৃতজ্ঞ, অন্তত এই সংকটের সময়ে তিনি আমাদের পাশে থেকেছেন', জানিয়েছেন দেবব্রতর ছেলে রঞ্জিত মাইতি।
সঙ্গত কারণেই মাইতি পরিবার রয়েছে বিপর্যয় এবং উৎকণ্ঠার মাঝে, অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে তাঁদের। দেবব্রতর কন্যা সাগরিকা মাইতি ২০২১ সালের ২ মে-র পর থেকে ভালো করে দু'চোখের পাতা এক পর্যন্ত করতে পারেন না, বাবার মতো ঘুমও যেন ছেড়ে গিয়েছে তাঁকে।
"সে দিন সন্ধেয় নির্বাচনের ফল ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই আমাদের এলাকায় একটা গোলযোগ শুরু হল। বাবা গিয়েছিলেন সেখানে দেখতে ব্যাপারটা কী! ওরা বাবা, আমার কাকা এবং আরও বেশ কিছু লোকজনকে নির্মম ভাবে পেটায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁদের, কিন্তু বাবার ক্ষেত্রে কোনও লাভ হয়নি- হাসপাতালে বাবার মৃত্যু হয়। আদালত এর পরে সিবিআই (CBI) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল, ২৪ ঘণ্টার জন্য আমাদের বাড়ি পাহারা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছিল। কিন্তু সে আর কত দিন, ওঁরা চলে গেলে আমাদের কী হবে? ওঁরা তো আর সারা জীবন আমাদের সুরক্ষা দেবেন না, তার পরে আবার আমাদের আক্রমণের মুখে পড়তে হবে", বলছেন সাগরিকা।
সাগরিকা একা নন, চিলাগ্রামের সমস্ত বাসিন্দাই এখন দিন কাটান নিদারুণ আতঙ্কের মাঝে!
মাইতি হত্যাকাণ্ডের বর্তমান পরিস্থিতি কী?
দেবব্রতর মৃত্যুর পর তৃণমূল কংগ্রেসের ৪৪ জন সদস্যকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচন এজেন্ট শেখ সুফিয়ান (Shek Sufian) এবং তৃণমূল কংগ্রেসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা আবু তাহেরের (Abu Taher) নামও ছিল এফআইআর-এ। এখনও মাইতি হত্যাকাণ্ডে হাজতবাস করছেন ১২ জন তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য।
"আমরা জানিই না মাইতি কে! মিথ্যে অভিযোগ এনে এই মামলায় আমাদের ফাঁসানো হয়েছে। ১৮ মে সিবিআই আমায় ডেকেছিল। আমি যাইনি, গেলেই তো ওরা আমায় জেলে ভরে দিত। আমি সিবিআইয়ের কাছ থেকে সময় চেয়েছি এবং আইনজীবীদের পরামর্শও নিচ্ছি এই পরিস্থিতিতে কী করা যায় তার জন্য। আমাদের ১২ জন সদস্যকে বিনা দোষে জেলে ভরে রাখা হয়েছে", আবু তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে নিউজ১৮-কে একথা জানিয়েছেন তিনি।
ভারতীয় জনতা পার্টি এব্যাপারে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকেই তর্জনী তুলেছে, অভিযোগ স্থানীয় পুলিশকে ব্যবহার করেছে রাজ্যের শাসক দল। অন্য দিকে তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযোগ- সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইভেস্টিগেশনকে (Central Bureau of Investigation) ঢাল করে ঘটনার ফায়দা তুলতে চাইছে কেন্দ্রীয় শাসক দল।
নন্দীগ্রাম কেমন আছে?
নন্দীগ্রামের দখল নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি হোক বা তৃণমূল কংগ্রেস- কেউ একে অপরকে সূচ্যগ্র ভূমি ছাড়তে রাজি নয়। নন্দীগ্রাম বাজারের কাছে ভারতীয় জনতা পার্টির অফিসে গিয়ে দেখা গেল তা যেন নির্বাচনের আঁচে ফুটছে! সাহেব দাস নামের স্থানীয় ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা জানালেন, "এই তো সে দিন ওরা শুভেন্দু অধিকারীর বাড়ি তথা অফিসে পুলিশ পাঠিয়েছিল! যাই হোক, পঞ্চায়েতে আমরাই ভালো ফল করব"!
হিসেব মতো, পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৩ সালে। যা দেখা গেল, এখন থেকেই তার প্রস্তুতিতে কোমর বেঁধেছে নন্দীগ্রাম!
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।