#দারিবেড়িয়া: মহিষাদলের গণ্ডি পেরিয়ে তখন আমরা সুতাহাটার পথে৷ বর্ধিষ্ণু মহিষাদলের চিত্র, রাজবাড়ির দালানের ঐতিহ্য তখনও চোখের সামনে ভাসছে৷ থমকে দাঁড়াতেই হল দারিবেড়িয়া মোড়ের কাছে৷ বাঁশের মাথায় ত্রিপল ঢেকে কোনও মতে বাঁচার সংস্থান৷ অলস দুপুরে বাইরে পিচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন বদ্ধা৷ আমাদের দেখেই অসহায় গলায় আর্তি, "ভাগ্যিস ঝড়টা আসেনি৷ এলে কোথায় যেতাম?"
একটু আগেই যে অঞ্চলের মানুষের মুখে মহিষাদলের রাজাদের গুণগান, শিক্ষা-সমস্কৃতির গর্ব শুনেছিলাম, তার মাত্র কয়েক মাইল পরেই এমন বাস্তবের কাছে যেন মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে ইতিহাস৷ শুধুমাত্র মহিষাদল এলাকাতেই রয়েছে মেদিনীপুরের দুটো বড় কলেজ৷ ব্রিটিশ সরকারের আমলে মহিষাদলের রাজা লছমন প্রসাদ গর্গ-এর হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মহিষাদল রাজ হাইস্কুল৷ স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় মহিষাদল রাজ কলেজ৷ শুধু মহিষাদল নয়, তমলুকে শান্তনাময়ী হাইস্কুল, এমনকী কলকাতার হিন্দু হোস্টেল, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিও গড়ে উঠেছিল যাদের পৃষ্ঠপোষকতায়, সেখানে মাত্র কয়েক কিলোমি়টারের মধ্যে দারিবেড়িয়া রয়ে গিয়েছে শিক্ষার আলোর বাইরেই৷ "আগে ১০০ দিনের কাজ করতাম, এখন শরীরে পারি না৷ শরীরে পারলেও পেতাম কিনা ঠিক নেই৷ ছেলেদুটো যে কোথায় গেলে জানি না৷ এখানে তো কোনও কাজ নেই৷ কোথায় যে আছে, ফেরেও না৷ আবার বিয়ে করেছে কিনা কে জানে... এদিকে বউমা আমার লোকের দুয়ারে কাজ করে সংসার টানছে৷ সবাই তো গরিব এখানে৷ কেই বা টাকা দেবে বলো? নাতিটা ঘুমোচ্ছে ঘরে, এখন তো গরমের ছুটি স্কুলে৷ স্কুলটা খোলা থাকলে তাও তো রোজ মিড ডে মিলটা পায়৷ এখন তো আমাদের দিকে তো কেউ দেখে না...
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বরাবরই সক্রিয় ছিল মহিষাদল রাজবাড়ির ভূমিকা৷ ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতা করায় শিক্ষার প্রসারে যেমন অগ্রগতি হয়েছিল তেমনই স্বাধীনতার আগে ও পরে ভারতের রাজনীতিতেও ছিল তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ৷ ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর ২৯ সেপ্টেম্বর থানা দখল আন্দোলনের সময় হাজার হাজার মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছিলেন রাজা ভবাণীপ্রসাদ গর্গ মহাশয়ের দেহরক্ষী৷ ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল এই ঘটনায়৷ আহত হয়ে পড়েন আরও বহু মানুষ৷ তবে রাজবাড়ির সংস্কৃতি প্রিয় মানুষরা কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না৷ ভবাণীপ্রসাদ গর্গ কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এই ভুল করে ফেলেছিলেন৷ যদিও এই ভুল ক্ষমা করেছিল সাধারণ মানুষ৷ যার উত্তর মিলেছিল ১৯৫২ সালের নির্বাচনে৷
স্বাধীনতার পর রাজা দেবপ্রসাদ গর্গ বাহাদুর ভোটে দাঁড়ান৷ ১৯৫২ সালে কংগ্রেসের হেভিওয়েট প্রার্থী সুশীলকুমার ধাড়াকে ২৬ হাজার ভোটে হারান তিনি৷ পরবর্তী সময়ে অবস্থান বদল করেছিল রাজবাড়ি৷ স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাদের সংযোগ ঘটে৷ কংগ্রেস সরকার ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাজবাড়ির সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ রাজা বিধান রায়, প্রফুল্ল সেনের পদার্পণ হয় রাজবাড়িতে৷ আজকের রাজনীতির সঙ্গে রাজবাড়ির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও বর্ধিষ্ণু মেদিনীপুর এখনও সেই ইতিহাস আঁকড়ে ধরে বাঁচতেই ভালবাসে৷ বাস্তবের থেকে মুখ ফিরিয়েই৷ প্রদীপের তলায় তাই অন্ধকারটা থেকেই যায়৷
২০০ বছর পরেও মহিষাদল রাজবাড়ির ১৭ চূড়ার রথের মাথা দৃশ্যমান হয় না দারিবেড়িয়া থেকে৷ সময় যত এগিয়েছে অগ্রসর মেদিনিপুরের যোগাযোগ তত কমেছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে৷ মহিষাদলের ক্ষোভ শুধু আটকে থাকে রাজবাড়ির দালানেই৷ রাজবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করে পর্যটন গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা মহিষাদলের মানুষের থেকে আরও দূরে সরে যায় দারিবেড়িয়ার ন্যূনতম বেঁচে থাকার আর্তি৷ ভোটের আগে মহিষাদলের মানুষেরা যেখানে দাবি তোলে আলাদা পুরসভা গঠনের, দারিবেড়িয়া সেখানে পঞ্চায়েতের ওপর আশা হারিয়ে অসহায় দিন গোনে৷ আগামী ১২ মে গোটা পূর্ব মেদিনীপুরের সঙ্গে ভোট দেবে দারিবেড়িয়াও৷ তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে মহিষাদল, নন্দীগ্রাম, হলদিয়ার সঙ্গেই ভোট দারিবেড়িয়াতেও৷
পঞ্চায়েত ভোটের পর কেটে গিয়েছে এক বছর৷ এবার লোকসভা ভোট৷ লড়াইযে নামছে তৃণমূলের দিব্যেন্দু অধিকারী, দুঁদে রাজনীতিক লক্ষ্ণণ শেঠ এবার কংগ্রেস পা্র্থী৷ কিন্তু লড়াইটাই যেখানে বেঁচে থাকার সেখানে ভোট থেকে আর কীই বা আশা করেন তারা? "ভোট তবু দেবোই, অধিকার ছাড়বো না..." এ অধিকার যে সত্যিই বেঁচে থাকার অধিকার৷
কাজের প্রয়োজনেই দারিবেড়িয়া ছেড়ে এগোতে থাকি সামনে৷ সুতাহাটা মোড় পেরোতেই স্পষ্ট হতে থাকে ব্যস্ত বন্দর শহর৷ কারখানার শেড, হলদিয়া সিটি সেন্টার পাশ কাটিয়ে ছোটে গাড়ি৷ দূরে চিমনির ধোঁয়ায় বিকেল নামে হলদিয়ায়৷ কর্মব্যস্ত দিন শেষে হলদি নদীর বাঁধানো ঘাটে হাওয়া খেতে বেরোয় হলদিয়া টাউনশিপ৷ জমে ওঠে রাজনৈতিক তরজা৷ঘুম থেকে উঠে লম্ফ জ্বালিয়ে পড়তে বসে বৃদ্ধার নাতি...
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Elections 2019, Loksabha Elections 2019, Sixth Phase Voting, Special Story, West Bengal Lok Sabha Elections 2019