#দিল্লি: তাঁকে রাজনীতিক বলা চলে না৷ কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতি এখন তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ৷ প্রশান্ত কিশোরের ক্ষুরধার মস্তিষ্কই সব হিসেব নিকেশ উল্টে দিয়ে ভোটের ফলাফলে নির্ণায়ক বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ একবার নয়, একের পর এক নির্বাচনে তা পরীক্ষিত সত্য৷ যার সর্বশেষ উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ এবং তামিলনাড়ু৷ আর সেই কারণেই গোটা দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসা কংগ্রেসও এখন পিকে-র দ্বারস্থ৷ কীভাবে কংগ্রেসকে বাঁচিয়ে তোলা হবে, প্রশান্তের কাছে এখন সেই সমাধান সূত্রেরই খোঁজ করছেন রাহুল- সনিয়ারা৷ সব দেখে মনে হচ্ছে, প্রশান্তের কাছেই যেন কোনও জাদুকাঠি আছে৷ যার ছোঁয়া পেলে যে কোনও দলই হয়তো ভোটের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হবে৷
কিন্তু কে এই প্রশান্ত কিশোর, কীভাবে শুরু হয়েছিল তাঁর পেশাদার জীবন? রাজনীতিতেই বা পা রাখা কীভাবে? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন প্রশান্ত কিশোর৷ রাষ্ট্র সংঘের হয়ে টানা আট বছর এই ভূমিকা পালন করেন তিনি৷ এর পরেই রাজনীতির আঙিনায় পা রাখা তাঁর৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদির প্রচার কৌশল নির্ধারণ করার দায়িত্ব বর্তায় পিকে-র উপরে৷ সেই সময় মোদির অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তিনি৷ ঘটনাচক্রে সেই প্রশান্তের জন্যই নরেন্দ্র মোদির বাংলা দখলের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে৷ আবার ২০২৪-এ নরেন্দ্র মোদিকে দিল্লির মসনদ থেকে সরাতেও বিরোধীদের নিয়ে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দিয়েছেন প্রশান্ত৷
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরেই বিজেপি-র সঙ্গে প্রশান্তের দূরত্বের সূত্রপাত৷ ২০১৫ সালে বিহারে বিধানসভা নির্বাচনে জেডিইউ, আরজেডি, কংগ্রেসকে নিয়ে বিজেপি বিরোধী মহাজোট তৈরি করে ফেলেন তিনি৷ শেষ পর্যন্ত প্রশান্ত কিশোর যদি সত্যিই কংগ্রেসে যোগ দেন, তাহলে রাজনীতিক হিসেবে তা হবে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস৷ এর আগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ-তে যোগ দিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর৷ কিন্তু ২০২০ সালে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে সমর্থন জানানোয় প্রকাশ্যেই নীতীশের নীতির সমালোচনায় সরব হন পিকে৷ এর পরেই জেডিইউ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়৷
২০১৪ সালে বিজেপি-র প্রচার কৌশল নির্ধারণের প্রস্তুতি হিসেবে ২০১৩ সালে নিজের মিডিয়া এবং পাবলিসিটি সংস্থা সিটিজেন্স ফর অ্যাকাউন্টেবল গভার্নেন্স বা ক্যাগ তৈরি করেন প্রশান্ত৷ মোদিকে প্রাক্তন 'চাওয়ালা' হিসেবে তুলে ধরে প্রচার শুরুর নেপথ্যে ছিল পিকে-এর এই সংস্থাই৷ এ ছাড়াও ২০১৪-র ভোট প্রচারে মোদির সমর্থনে চায় পে চর্চা, থ্রি ডি জনসভা, রান ফর ইউনিটি-র মতো বিভিন্ন অভিনব প্রচার ভাবনাও ছিল প্রশান্ত কিশোরের মস্তিষ্কপ্রসূত৷ মোদির প্রচার টিমের অন্যতম মূল মাথাই ছিলেন প্রশান্ত৷ কিন্তু ২০১৪ সালের পরেই বিজেপিএবং নরেন্দ্র মোদির সঙ্গ ত্যাগ করে আই প্যাক তৈরি করেন প্রশান্ত কিশোর৷
আই প্যাক তৈরির পরই ২০১৫ সালে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে বড় সাফল্য পান প্রশান্ত কিশোর৷ নীতীশ কুমারকে তৃতীয় বার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসানোর পিছনে বড় ভূমিকা নেন তিনি৷ বিহার নির্বাচনে জয়ের পরেই প্রশান্ত কিশোরকে পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিজের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন নীতীশ৷ বিহারে জয়ের পরই প্রশান্ত এবং নির্বাচনী সাফল্য কার্যত সমর্থক হয়ে দাঁড়ায়৷
বিহারের পরেই ২০১৭ সালে পঞ্জাবের নির্বাচনের জন্য প্রশান্ত কিশোরকে নিযুক্ত করে কংগ্রেস৷ সেই সময় ক্যাপ্টন অমরিন্দর সিংকে কংগ্রেস নেতৃত্ব মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করতে চাইলেও তাঁকে নিয়ে পঞ্জাবের দলীয় নেতৃত্বের একাংশের অসন্তোষ ছিল৷ একদিকে কংগ্রেসের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, অন্য দিকে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে চাপা দিতে প্রশান্তই ছিলেন ভরসা৷ যথারীতি প্রশান্তের টোটকায় বিজেপি- অকালি জোটকে হারিয়ে পঞ্জাব দখল করে কংগ্রেস৷ 'কফি উইথ ক্যাপ্টেন', 'পঞ্জাব দ্য ক্যাপ্টেন' মতো প্রচার কৌশল তৈরি করে পঞ্জাবে বাজিমাত করেন পিকে৷ আগামী বছর ফের পঞ্জাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে সেই প্রশান্তই ভরসা কংগ্রেসের৷
তবে রাজনৈতিক কুশলী হিসেবে প্রশান্তের কেরিয়ারে একমাত্র লাল কালির দাগ লাগে ২০১৭ সালের উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে৷ বিজেপি যেখানে ৩০০-র বেশি আসন পায়, সেখানে কংগ্রেসের ঝুলিতে আসে মাত্র সাতটি আসন৷ উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যে যেখানে কংগ্রেস যথেষ্ট দুর্বল, সেখানে প্রশান্ত কীভাবে রাহুল, সনিয়াদের হয়ে বাজি ধরেছিলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল রাজনৈতিক মহলে৷ তবে একটি ব্যাখ্যা হল,কংগ্রেস নেতৃত্বের একটা বড় অংশই উত্তর প্রদেশ নিয়ে প্রশান্তের পরামর্শ মানতে চাননি৷
কিন্তু উত্তর প্রদেশের ব্যর্থতা যে ব্যতিক্রম ছিল, অন্ধ্র প্রদেশেই তা বুঝিয়ে দেন পিকে৷ তাঁর হাত ধরেই ওয়াইএসআর কংগ্রেসের ভোল বদলে যায় দক্ষিণের রাজ্যে৷ ২০১৯ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অন্ধ্র প্রদেশে ১৭৫টি আসনের মধ্যে ১৫১টিতে জয়ী হয় জগনের দল৷ ২০২০ সালে প্রবল মোদি হাওয়ার মধ্যেও দিল্লিতে আম আদমি পার্টির একপেশে জয়ের পিছনেও প্রশান্ত কিশোরের কৃতিত্ব রয়েছে৷ তবে তাঁর সাফল্যের মুকুটে সম্ভবত সবথেকে বড় পালক ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন৷
পশ্চিমবঙ্গ দখলে মরিয়া মোদি- শাহ সহ বিজেপি নেতৃত্ব সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েছিল৷ বিজেপি বাংলা দখল করছে, এমন বাজি ধরে ফেলেছিলেন অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞও৷ মোদি- শাহরা যখন বাংলায় ২০০ আসন পেয়ে ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বুঁদ, তখন ভোটের ফল প্রকাশের বহু আগে পিকে-র ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, বাংলায় বিজেপি ১০০ আসনে পৌঁছবে না৷ সেই সময় অনেকেই তাঁর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিলেন৷ ভোটের ফল প্রকাশের পর অবশ্য সেই সমালোচকদের চুপ করিয়ে দিয়েছেন পিকে৷ আর পশ্চিমবঙ্গের এই ফলের পরই ২০২৪ নিয়ে নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেছে বিরোধী দলগুলি৷ আর বিরোধী শক্তিকে এক সুতোয় গাঁথার ক্ষেত্রেও প্রধান ভূমিকা নিতে চলেছেন প্রশান্ত কিশোরই৷
পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ফল দেখার পর স্বভাবতই রাজনৈতিক মহলে পিকে-র চাহিদা আকাশছোঁয়া৷ কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামীও আশাবাদী, পিকে-র হাত ধরেই ২০২৩ সালের নির্বাচনে ফের কর্ণাটকে ঘুরে দাঁড়াবে তাঁর দল জেডিএস৷ ইতিমধ্যেই প্রশান্তের সঙ্গে ২০২৬ সাল পর্যন্ত চুক্তি সেরে ফেলেছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ তবে মঙ্গলবার সনিয়া- রাহুল গান্ধিদের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের পর এই সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে এখন একটি প্রশ্ন, কংগ্রেসের হয়ে কি রাজনীতিক হিসেবে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করবেন ভোট গুরু প্রশান্ত কিশোর?
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Prashant Kishor