মাস্ক বিক্রির আড়ালে অসাধু ব্যবসা ! কোন মাস্ক কিনবেন? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
- Published by:Piya Banerjee
Last Updated:
বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য একসঙ্গে দুটো মাস্ক পরা উচিত।
# শিলিগুড়ি: করোনা বা কোভিড শব্দটি শুনতে পেলেই তার সঙ্গে যে শব্দগুলি মাথায় আসে সেগুলি হল লকডাউন, সোশ্যাল ডিসটেন্সিং, স্যানিটাইজার এবং মাস্ক। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় থেকেই এই লকডাউন সোশ্যাল ডিসটেন্সিং স্যানিটাইজারের ব্যবহার যথেষ্টভাবে বেড়েছে। সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে মাস্কের ব্যবহার। প্রথম অবস্থায় মানুষ সেই অর্থে মাস্কের ব্যবহার না করলেও, এখন কিন্তু মানুষ যথেষ্ট ব্যবহার করছে মাস্ক। আর তাতেই চাহিদা বেড়েছে করোনা প্রতিরোধের এই প্রাথমিক ওষুধের।
শিলিগুড়ির প্রায় সর্বত্রই রাস্তার মোড়ে মোড়ে ব্যবসায়ীরা মাস্কের পসরা নিয়ে দোকান খুলে বসেছেন। রংবেরঙের বিভিন্ন দামের ও মানের মাস্কের পাশাপাশি রয়েছে নানান ধরনের স্যানিটাইজারও। শিলিগুড়ি শহরের বিধান মার্কেট, হংকং মার্কেট, হাকিম পাড়া, কলেজপাড়া, শক্তিগড়, দেশবন্ধুপাড়া, আশ্রমপাড়া, প্রধাননগরের মতো ব্যস্ততম এলাকা থেকে শুরু করে গোটা শহরেই ছেয়ে গিয়েছে এই মাস্কের দোকানগুলির। বিভিন্ন দামের মাস্ক থাকায়, সাধারণ মানুষ নিজের সাধ্য মতো মাস্ক কিনে নিচ্ছেন এই সব দোকানগুলি থেকে।
advertisement
বিধান মার্কেটের এক ব্যবসায়ী সুবীর পাল বলেন, 'ন্যূনতম ১০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা অব্দি আমার কাছে বিভিন্ন দামের মাস্ক রয়েছে। শুধু মাস্কই নয়, বিভিন্ন দামের স্যানিটাইজারও রয়েছে।' তবে করোনা প্রতিরোধে কোন মাস্ক কতটা সক্রিয় সে প্রশ্নের উত্তরে সুবীরবাবু নিরুত্তর। তিনি বলেন, 'আমার কাছে কাপড়ের মাস্ক থেকে শুরু করে সার্জিক্যাল মাস্ক এমনকি ডাক্তারদের বলা এন-৯৫ মাস্কও আছে। এগুলি বিভিন্ন দামেরও রয়েছে। সুতরাং যার যেটা পছন্দ সে সেটাই নিচ্ছে।'
advertisement
advertisement
সুভাষপল্লীতে মাস্ক ও স্যানিটাইজার কিনতে এসেছিলেন উত্তম চক্রবর্তী। কী মাস্ক নিচ্ছেন উত্তমবাবুকে প্রশ্ন করা হলে তিনি অবশ্য বলেন, 'কোন মাস্ক পরলে করোনাকে আটকানো সম্ভব তা জানিনা। তবে টিভিতে দেখি ডাক্তারবাবুরা দুটো মাস্ক পরতে বলছেন। তাই ওই একটা সার্জিক্যাল মাস্ক ও একটি কাপড়ের মাস্ক নিতে এসেছি। পুরোনো মাস্কগুলো বেশিদিন ব্যবহারযোগ্যও নয় বলে সংবাদমাধ্যমেই জানতে পেরেছি।'
advertisement
তবে প্রশ্ন উঠছেই কোন মাস্ক সাধারণ মানুষ ব্যবহার করবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে নানান মুনির নানান মত। কেউ বলছেন সার্জিক্যাল মাস্ক, তো কেউ বলছেন এন-৯৫। আবার কেউ কাপড়ের মাস্কেরও পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি করে মাস্ককে গ্রহণযোগ্য ও সার্টিফাইড করেছে। সেই দেশগুলি সরকার সেই মাস্ককেই ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু ভারতে এখনও পর্যন্ত সেইভাবে কোন সরকারি তরফে 'প্যারামিটার' নেই। নেই আইএসআই স্ট্যান্ডার্ডও।
advertisement
কোন মাস্কের কত দাম এবং সেটিকে কিভাবেই বা পরতে হবে সে ব্যাপারে বিবৃতি তো দূরের কথা কোন নির্দেশিকাই নেই। ফলে আমজনতা বিভ্রান্তির পাশাপাশি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পর লকডাউনের পথে হাঁটতে হয়েছে সরকারকে। বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য একসঙ্গে দুটো মাস্ক পরা উচিত। তবে খেয়াল রাখতে হবে একসঙ্গে একই রকমের দুটি মাস্ক কখনওই ব্যবহার করা যাবে না। তাতে সংক্রমণের ঝুঁকি আগের মতোই থেকে যায়।
advertisement
শিলিগুড়ি শহরের বিশিষ্ট প্রবীণ চিকিৎসক ডাঃ কৌশিক ভট্টাচার্য বলেন, 'বাজারে এখন সবচেয়ে বেস্ট মাস্ক এন-৯৫ মাস্ক। অনেক এন-৯৫ মাস্ক ভাল্ভ সমেত থাকে। আমার মতে ভাল্ভ ছাড়া মাস্কটাই সবচেয়ে ভালো। এটা না পাওয়া গেলে যেকোনও সার্জিক্যাল মাস্কের ওপরে কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করলে সেটা একবেলা বা দু'বেলা ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। ডাবল মাস্কিং এখন খুব জরুরী।'
advertisement
মাস্কের জন্য সুতির কাপড়কেই উপযুক্ত মনে করছেন কৌশিকবাবু। তিনি বলেন, 'দামের সঙ্গে মাস্কের তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ যাঁরা সমাজে আর্থিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে, তাঁরা সার্জিক্যাল মাস্কের ওপরে যেকোনও কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন। সামর্থ থাকলে এন-৯৫ মাস্ক ব্যবহার করা যেতেই পারে।'
অপরদিকে, উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্যাথোলজি বিভাগের অধ্যাপক তথা চিকিৎসক ডাঃ কল্যাণ খান বলেন, 'রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া মাস্ক দু'ধরণের সমস্যার কারণ। প্রথমত সেগুলি ট্রিপল লেয়ার নয়। বেশিরভাগ কাপড়ের মাস্ক। সার্জিক্যাল মাস্ক যেগুলো রাস্তার ধারে বিক্রি হচ্ছে সেগুলোও ট্রিপল লেয়ার নয়, যেটা প্রয়োজন এই সময়ে। অন্যদিকে যেগুলো এন-৯৫ নামে বিক্রি হচ্ছে সেগুলি আদৌও এন-৯৫ কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কিন্তু দামটা বেশি রাখা হচ্ছে। সেখানে সাধারণ মানুষ একরকম প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, রাস্তার পাশে বিক্রয় হওয়া মাস্কের কোনও কভার থাকে না, খোলা ঝুলিয়ে রাখা হয়। গ্রাহকদের মাস্ক দেখে হাতে নিয়ে দোকানেই রেখে যাওয়ার সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে সংক্রমণ বাড়ার একটি সম্ভাবনা রয়েছে।'
কল্যাণবাবুর মতে, 'সার্জিক্যাল মাস্ক আমাদের ৬০-৭০ শতাংশ সুরক্ষিত করে। কিন্তু যখন আমরা সেটি কিনব, সে যেকোনও দোকান থেকেই হোক না কেন, আমাদের বাড়িতে এসে দেখে নিতে হবে সেখানে তিনটে লেয়ার আছে কিনা! দেখতে হবে জলধারণ ক্ষমতাটা কতটুকু। জল ঢাললে যাতে মাস্ক বেয়ে চলে না যায়। এটা আমাদের দেখে নিতে হবে।'
এদিকে, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি) খড়গপুরের গবেষক তথা শিলিগুড়ির বিশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা লিভ লাইফ হ্যাপিলির কর্ণধার অনির্বাণ নন্দীর কথায়, 'একদিকে মাস্কের প্রচুর দোকান হওয়ায় বাড়ি থেকে কেউ মাস্ক পরে আসতে ভুলে গেলে কিনতে পারছেন। অথবা বাজারে প্রয়োজন হলে মাস্ক কিনে পরছেন। সেক্ষেত্রে এটা সুবিধা যে মাস্ক ব্যবহারের ও সচেতনতা কিয়দংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, অসাধু ব্যবসায়ীরা যে আঁখের গোছাতে ব্যস্ত, তাদের সতর্ক করতে হলে সাধারণ গ্রাহকরাই পারবেন। তাছাড়া কেউ না।'
অনির্বাণবাবু বলেন, 'এমন একটা রেগুলেশন চালু করা দরকার, যেখানে এন-৯৫ মাস্কের সঠিক দাম রাখা থাকবে, আসল কিংবা নকল এন-৯৫ মাস্কের তফাৎ, সবটাই ব্যবসায়ী থেকে গ্রাহকদের কাছে স্বচ্ছ হোক।'
অন্যদিকে, প্রাক্তন সাংবাদিক তথা ডুয়ার্সের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্নেহ ফাউন্ডেশনের কর্ণধার অভিষেক ঘোষ বলেন, 'অনেকেই আর্থিকভাবে পিছিয়ে রয়েছেন। তাঁরা একটি সার্জিক্যাল মাস্ক কিনে তার ওপর কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করতেই পারেন। কারণ সার্জিক্যাল মাস্কের খুব একটা দাম হয় না। তবে নামি-দামি মাস্কবিক্রির আড়ালে অনেকেই নিজেদের অসাধু কারবার ছড়িয়ে বসেছে। প্রশাসনের সতর্ক করা উচিত। এতে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি না, ছড়াতে পারে ভয়ানক রোগও।'
Vaskar Chakraborty
Location :
First Published :
June 12, 2021 10:17 PM IST