রবি যখন চিত্রকর, কলমের টানে অন্য কবিতা
Last Updated:
গানই হল হাজার দুয়েক, ছবি হল হাজার দুয়েক ৷ বই, মুঠো মুঠো লিখেছি ৷ অত বেশি আর ভালো নয় ৷
#কলকাতা: গানই হল হাজার দুয়েক, ছবি হল হাজার দুয়েক ৷ বই, মুঠো মুঠো লিখেছি ৷ অত বেশি আর ভালো নয় ৷ এবারে থামা উচিত৷’-এ কথা স্বয়ং বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ ১৯৩৯ সালের ২৪ জুলাই, রাণী নিজের কাজের পরিসংখ্যান দিতে গিয়ে ঠিক এই কথাই উঠে আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখে ৷ ‘আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ’ বইতে রাণী চন্দ লিখছেন, একটা সময় রবি ঠাকুর মনে করছেন, তাঁর কাজের ভার অনেক ৷ কবিতা লিখেছেন, গান লিখেছেন, উপন্যাস, প্রবন্ধ ৷ ক্যানভাসে তুলি রেখে ছবিও এঁকে ফেলেছেন প্রচুর ৷ আর এই সবকেই কর্মের ভার বলে বর্ণনা করেছেন কবি নিজেই ৷
অগোছালো খেয়ালকে তিনি সাদা ক্যানভাসে ধরতেন ৷ যে কথাগুলো গানে অনুচ্চারিত, তা হয়তো ফুটিয়ে তুলতেন তুলির টানে ৷ তবে সব সময় যে একেবারে চিত্রকরের নিয়ম মেনে, তা নয় ৷ বরং ক্যানভাসেও নিয়মভাঙার খেয়ালে মাততেন কবি ৷ তাই তো কবিতা, গান, প্রবন্ধ লেখার মাঝে মাঝেই আপন খেয়ালে কলমের কালি দিয়েই ফুটিয়ে তুলতেন নিজের মনের ছবি ৷
advertisement
advertisement
আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ বইয়ে রাণী চন্দ লিখছেন, চিত্রকর হিসেবে কবির আত্মপ্রকাশ কিন্তু অনেক দেরিতে ৷ তবে অদ্ভুত মিল বললে ভুল বলা হবে না, কবি জীবনের প্রথম পর্বে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছিলেন ‘ছবি ও গান’ ৷ গোটা জীবনে ঠিক ক’টা ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ তার পরিসংখ্যান পাওয়া বেশ শক্ত ৷ যদি রাণী চন্দের আলাপচারি রবীন্দ্রানাথের প্রসঙ্গ তোলা হয়, তা হলে হাজার দু’য়েক ৷
advertisement
সালটা ১৯৩০ ৷ জুলাই মাস ৷ প্যারিস, বার্মিংহাম এবং লন্ডনের পর জার্মানির নানা শহরে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রদর্শনী যখন চলছে, সেই সময় রবীন্দ্রনাথ কন্যা মীরাকে একটি চিঠি লেখেন, সেই চিঠিতে তিনি জানিয়ে ছিলেন, তাঁর আঁকা ছবি চুরি যাওয়ার কথা ৷ কখনও লন্ডন, কখনও জেনেভা, প্যারিস, বার্লিনেই বার বার প্রর্দশীত হয়েছে রবি ঠাকুরের আঁকা ছবি ৷ সেই তুলনায়, এদেশে রবি ঠাকুরের ছবি নিয়ে তেমন কাজ চোখে পড়ে না ৷ মীরাদেবীকে লেখা রবি ঠাকুরের নানা চিঠিতেই বার বার ধরা দিয়েছে দেশ-বিদেশের নানা ছবি প্রর্দশনীর কথা ৷
advertisement
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতেই পারে, দেশে নিজের ছবি প্রর্দশনী নিয়ে একটু আপত্তি বা অভিমান ছিল রবি ঠাকুরের ৷ আর তার প্রমাণ মেলে প্রিয়জনদের লেখা রবি ঠাকুরের কিছু চিঠি-পত্রতেই ৷ প্রতিমা দেবী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ইন্দিরা দেবী, রানু অধিকারী, রাণী মহলানবিশ বা নন্দলাল বসুর মতো প্রিয়জনকে লেখা একাধিক চিঠিতে ধরা পড়েছে রবি ঠাকুরের সেই অভিমানি কণ্ঠস্বর ৷ যেমন, রবি ঠাকুর কয়েকটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘পণ করেচি আমার জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাব না ৷ অযোগ্য, অভাজনদের স্থূল হস্তাবলেপ অসহ্য হয়ে এসেচে ৷ আমার এই শেষ কীর্তি এই দেশেই রেখে যাব ৷ এবার দেশে ফিরলে হয়তো একটা অভিনন্দনপত্র ও ফুলের মালা পাওয়া যেতে পারে ৷ কিন্তু একটা ছবিও দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব না...... এই ছবিগুলো আমি পশ্চিমের হাতেই দান করেচি ৷’
advertisement
রবি ঠাকুরের ছবির কিছু বৈশিষ্ঠ ছিল ৷ বলা ভালো, সাধারণ প্যার্টানকে কখনই অনুসরণ করেননি তিনি ৷ বরং আঁকাবুকি-র মধ্যে দিয়েই ইমেজের জন্ম দিতেন রবীন্দ্রনাথ ৷ আর এক্ষেত্রে সাধারণত, কলমের কালি, ইন্ডিয়ান ইঙ্ক বেশি ব্যবহার হতো ৷ আঁকা ক্ষেত্রে তুলির বদলে কলমের পিছনের অংশ ও হাতের আঙুল, চেটোই বেশি ব্যবহার করতে তিনি ৷
advertisement
নন্দলাল বসু, রবি ঠাকুরের ছবিগুলো সম্পর্কে বলেছেন, রবি ঠাকুরের ছবিতে ৩ টি মূল জিনিস লক্ষ্য করা যায়, ছন্দ, ভারসাম্য এবং চরিতার্থতা ৷ এই গুণগুলো তিনি পেয়েছেন তাঁর কবিতা ও গান লেখার অভিজ্ঞতা থেকে ৷
নিজের ছবি নিয়ে বেশ কিছু কথা, চিত্রকর যামিনী রায়কে একবার চিঠিতে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ৷ রবি ঠাকুর চিঠিতে লিখলেন, হয়তো আমার ছবিগুলো সম্পূর্ণ নয়, যেমনটি তাঁদের হওয়ার কথা ছিল ৷ তবে যামিনী রায় ছিলেন ঠাকুরের ছবির অন্ধভক্ত ৷ রবি ঠাকুরের ছবি প্রসঙ্গে যামিনী রায় বলেছিলেন, ‘আমি রবি ঠাকুরের ছবিগুলো পছন্দ করি ৷ কারণ, ছবিগুলোর অভ্যন্তরীণ শক্তি এবং অবিশ্বাস্য ছন্দের জন্য ৷ এবং ছবিগুলোতে শিল্পীর যে শৈল্পিক সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয় তা বর্ণনার ভাষা আমার নেই ৷ ’
advertisement
নানা বই, প্রবন্ধ, প্রচ্ছদ থেকে জানা যায়, রবি ঠাকুর কখনই গুছিয়ে বা বলা ভালো মনযোগ রেখে ছবি আঁকেননি ৷ বরং আপন খেয়ালেই তাঁর কলমের টানে সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন ছবি ৷ নতুন নতুন ভাবনার ৷ ঠিক যেমন রক্তকরবী-র পাণ্ডুলিপি ঠিক করার সময় কাটাকুটি করতে করতে তিনি এঁকে ফেলেছিলেন অদ্ভুত কিছু প্রাণী ও পাখির ছবি ৷ অন্যদিকে মাঝে মধ্যেই রবি ঠাকুরের কলমে ফুটে উঠত দুঃখিত এবং বিকৃত নারীর অবয়ব ৷
যারা রবীন্দ্রনাথের ছবির সাথে পরিচিত তারা অনেকেই জানেন তার ছবিতে গাঢ় রঙের আধিক্য অনেক চোখে পড়ে। এটার কারণও সম্ভবত তার দৃষ্টির ‘উনতা’ অর্থাৎ বর্ণান্ধতা। প্রোটানোপদের ছবিতে নাকি এটা দেখা যায়। বিশেষ করে খয়েরি এবং কালো রঙের উগ্র ব্যবহার প্রোটানোপদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের বহু ছবিতেই তার হদিস মেলে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় খয়েরির প্রাধান্য অনেক বেশি বলেই দর্শকদের কাছে প্রতীয়মান হয়। লালচে খয়েরি, কালচে খয়েরি, নীলচে খয়েরি, বেগুনি-খয়েরি প্রভৃতির অনেক শেড রবীন্দ্রচিত্রকলাকে আচ্ছন্ন করে আছে, এবং এর প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথের বর্ণান্ধতা।
তবে একথা না বললেও হয়তো চলে যে, বর্ণান্ধতার ব্যাপারটি রবীন্দ্র চিত্রকলাকে একটি ভিন্নমাত্রা দিলেও তাঁর প্রতিভার স্ফুরণে এটি কোন সীমাবদ্ধতা তৈরি করেনি। তাঁর প্রতিভা আমাদের মনে করিয়ে দেয় লাডউইক ভ্যান বিথোফেনকে, যিনি জীবনের দীর্ঘ সময়টুকু কানে খাটো ছিলেন, কিন্তু তিনিই ছিলেন আবার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কম্পোজারদের শিরোমণি। বিথোফেনের বধিরতা তার সুরের মূর্ছনা তৈরিতে কোন প্রতিবন্ধকতা আনতে পারেনি। একই ব্যাপার রবীন্দ্রনাথের জন্যও খাটে।বিথোফেনের সুরের মূর্ছনার মতো রবীন্দ্রনাথের আঁকা স্বাতন্ত্র্য ধারার প্রায় তিন হাজার ছবি আমাদের জন্য আজ অমূল্য সম্পদ। এমনকি অনেক সময়ই তা ছাপিয়ে গেছে নোবেল পুরষ্কার পাওয়া তাঁর অতিপরিচিত কবি সত্ত্বাকেও।
তথ্যসূত্র: রবীন্দ্রচিত্রকলা, অচেনা ছবি, অজানা গল্প,
লেখক- সুশোভন অধিকারী
কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের সব লেটেস্ট ব্রেকিং নিউজ পাবেন নিউজ 18 বাংলায় ৷ থাকছে দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের খবরও ৷ দেখুন ব্রেকিং নিউজ এবং সব গুরুত্বপূর্ণ খবর নিউজ 18 বাংলার লাইভ টিভিতে ৷ এর পাশাপাশি সব খবরের আপডেট পেতে ডাউনলোড করতে পারেন নিউজ 18 বাংলার অ্যাপ ৷ News18 Bangla-কে গুগলে ফলো করতে ক্লিক করুন এখানে ৷
Location :
First Published :
May 09, 2018 11:17 AM IST