#কলকাতা: শেষ হল দিল্লির মসনদ দখলের ভোটযুদ্ধ ৷ চোদ্দকেও ছাপিয়ে গেল উনিশ। আবারও দেশ জুড়ে পদ্ম-ঝড়। মোদি ক্যারিশমাতেই ফের বিজেপির বাজিমাত। বিরোধীরা কুপোকাত। সিংহাসনের দখলের লড়াইয়ে সেনাপতিদের ভূমিকা অন্তত গুরুত্বপূর্ণ ৷ সেনাপতিদের হাত যশেই তো রাজার সিংহাসনে আরোহণ ৷ দেশ জুড়ে পদ্ম ঝড়ের পিছনে মগজাস্ত্র যার তিনি হলেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ৷ আর তার বিবেচনাতেই দেশ জুড়ে গেরুয়া শিবিরের ভার ছিল এক একেকটি অভিজ্ঞ ও পোক্ত কাঁধে ৷ সেই সেনাপতিদের ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্ক’-কেই ভোটবাক্সে ঝড় তুলতে চলেছে বিজেপি ৷
রাজ্যে দুই থেকে দুই অঙ্কের ঘরে বিজেপির আসন। এর আগে রাজ্যে সর্বোচ্চ লোকসভা আসন ছিল দুই। এবার একলাফে উনিশ। লোকসভা ভোটের ফলে এরাজ্যে তৃণমূলের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে বিজেপি। বাম ভোটব্যাঙ্ক শক্তি বাড়িয়ে দিল রাম শিবিরের। শাসক দল তৃণমূলের ভোটের একাংশও গেল পদ্ম শিবিরে। বরাবর এরাজ্যে পিছনের সারিতেই ছিল বিজেপি। কিন্তু, গতিবদল শুরু হয় গত বিধানসভা ভোটের পর থেকেই। রাজ্যে বিজেপির সম্ভাবনা দেখেই ২০১৯-র অঙ্ক কষা শুরু করেন মোদি-শাহরা।
২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর গো-বলয়ে উড়ছে জয়পতাকা। নরেন্দ্র মোদি - অমিত শাহদের নজর তখন পূর্বে। অসম, মণিপুরে ক্ষমতা দখলের পর পাখির চোখ পশ্চিমবঙ্গ। ২০১৬ তে চেষ্টা করেও এরাজ্যে দাঁত ফোটাতে পারেনি বিজেপি ৷ বাংলার ঘর জুড়ে তখন হাওয়ায় মাথা নাড়ছে শুধুই জোড়াফুল ৷ এমন অবস্থা থেকে ২০১৯ এ রাজ্যের মানচিত্রে ঘাসফুলের পাশাপাশি পদ্মফুলের উল্লেখযোগ্য ও সদর্প উপস্থিতি ৷ এমন পট পরিবর্তনের পিছনে যার ভূমিকা তিনি হলেন মুকুল রায় ৷
কে এই মুকুল রায়? জানতে হলে উল্টাতে হবে বাংলার রাজনীতির ইতিহাস ৷ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একসময়ের ডানহাত মুকুল রায় ৷ এখন ক্যাম্প বদলে জোড়াফুলের একসময়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কাঁধ, বাংলায় অমিত শাহের সেনাপতি ৷ ২০১৪ সালে এরাজ্যে বিজেপি ছিল মোটে দুটি আসন ৷ সেখান থেকে আজ বাংলার বিভিন্ন কোণে উড়তে চলেছে গেরুয়া ধ্বজা ৷ এই অসম্ভবকে সম্ভব করার পিছনে সিংহভাগ অবদান তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন সৈনিক মুকুল রায়ের ৷
সাল ১৯৯৮ ৷ বাংলার ঘটনাবহুল রাজনীতিতে আরও এক ঘটনা ৷ কংগ্রেস ছেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করলেন তৃণমূল কংগ্রেস ৷ এই তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ ছিলেন মুকুল রায় ৷ দলে বরাবরই তিনি থিঙ্কট্যাঙ্ক-স্ট্র্যাটেজি মেকারের ভূমিকায় থেকেছেন ৷ ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস ৷ সেই জয়ের কাণ্ডারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেও আসল ‘কুইন মেকার’ ছিলেন মুকুল ৷ রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের অঙ্ক তাঁর হাতের মুঠোয় ৷ তেমনই দখল তৃণমূল স্তরের সংগঠনের সমীকরণে ৷ ২০১১ থেকে রাজ্যে তৃণমূলের সাফল্যের পিছনে মমতার ক্যারিশমা ছাড়াও ছিল মুকুলের অবদান ৷ জোড়াফুলের সেই সেনাপতি এখন বাংলায় গেরুয়াশিবিরের অন্যতম থিঙ্কট্যাঙ্ক ৷
২০১৭ সাল অব্দি ভারতীয় সংসদের রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন মুকুল রায় । তিনি ২০১১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভারতের রেলমন্ত্রীও ছিলেন তিনি ৷ তৃণমূল কংগ্রেস দলের এমন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের দল ছাড়ার পিছনে ছিল স্বার্থ সংঘাত ৷ দলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড মুকুল রায়ের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৷ দুই টাইটানের অনুগামীদের মধ্যেও তৈরি হয় দ্বন্দ্ব ৷ দলে তৈরি হয় বিভাজন ৷ সমান্তরাল দুটি লবি কাজ করছিল দলে ৷ সেই জটিলতা থেকেই এতদিনের পুরনো দলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি ৷ ২০১৭ সালে অভিমানী মুকুল রায় কৈলাশ বিজয়বর্গীর হাত ধরে যোগ দেন বিজেপিতে ৷
শুধু রাজ্য নয়, জাতীয় স্তরের রাজনীতিতেও মুকুলের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট ৷ এই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়েছে রাজ্য বিজেপি ৷ রাজ্যে গেরুয়া শিবিরের অন্যতম ট্রাম্প কার্ড মুকুল রায় ৷ অন্যদল থেকে লোক টানায় জুড়ি নেই মুকুল রায়ের ৷ বহুবার অন্য দল থেকে লোক ভাঙিয়ে তৃণমূলে এনে ফলাফল বদলে দিয়েছেন তিনি ৷ সারা বাংলায় তৃণমূলের সাম্রাজ্য গড়ার ক্ষেত্রে একনম্বর কারিগর ছিলেন মুকুল রায় ৷ রাজ্যে গত দুবছর ধরে যে সংগঠন দিলীপ ঘোষ তৈরি করছিলেন তাঁকে আরও বাড়াতে থাকেন তিনি ৷ মুকুলের নেতৃত্বেই বাংলায় আস্তে আস্তে তৈরি হতে থাকে বিজেপির সংগঠন ও নেটওয়ার্ক ৷ একসময় ত্রিপুরায় তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠন তৈরির জন্য মুকুলকে পাঠিয়ে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ সেবার কংগ্রেস ও অন্যদল ভাঙিয়ে ত্রিপুরায় তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠন তৈরি করেন মুকুল ৷ ২০১৭ সালে সেই ত্রিপুরাতেই বিজেপির সংগঠন তৈরির কাজে দল পাঠায় একই ব্যক্তিকে ৷ উল্লেখ্য, মুকুল তৃণমূল ছাড়ার পরই ত্রিপুরায় তাঁর হাতে তৈরি জোড়াফুল সংগঠন ঝুঁকে পড়ে বিজেপির দিকে ৷ ফলে শুধু বাংলাতেই নয়, মুকুল রায় তৃণমূল ছাড়ায় ত্রিপুরাতেও লাভবান হয় বিজেপি ৷
২০১৭ সালে গোবলয় ও উত্তর-পূর্বে গেরুয়া ঝড়ের পর থেকেই মোদি-শাহের লক্ষ্য ছিল মিশন বাংলা ৷ কিন্তু বাংলায় কোনওদিনই তেমনভাবে সংগঠন ছিল না গেরুয়া শিবিরের ৷ ২০১৬ সালে চেষ্টা করেও বিধানসভায় মুখ থুবড়ে পড়ে বিজেপি ৷ সেই সংগঠন তৈরির অভাব পূরণ করতেই বিজেপিতে প্রবেশ মুকুলের ৷ দিলীপ ঘোষের সঙ্গে মিলে এরাজ্যে পরিবর্তনের পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন মুকুল রায় ৷
ইতিমধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসকে শূন্য থেকে ক্ষমতায় আনার অভিজ্ঞতা রয়েছে মুকুল রায়ের সিভিতে ৷ তাই স্ট্র্যাটেজিটা তাঁর জানাই ৷ এই অভিজ্ঞতায় বিপুলভাবে কাজে লাগিয়ে রাজ্য বিজেপি এখন ডানা মেলেছে বাংলায় ৷
সারা রাজ্যের প্রতিটি, জেলা, ব্লক, টাউনশিপ হাতের তালুর মতো চেনেন মুকুল ৷ একইসঙ্গে জানেন তাঁর পুরনো দল অর্থাৎ রাজ্যের শাসক দলের সমস্ত দুর্বলতা ও দুর্বলতম স্থানের খুঁটিনাটি জানেন মুকুল ৷ এরই ফায়দা পেয়েছে গেরুয়া শিবির ৷ কোন প্রার্থীকে কোথায় দাঁড় করালে লাভবান হতে পারে বিজেপি, সেই অঙ্কও ছিল মুকুলের চেনা ৷ তাতেই লোকসভায় বিজেপির উত্থান ৷
সংগঠন শুধু গড়া নয়, সংগঠনের প্রতিটা ব্যক্তিকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন মুকুল ৷ সেই সূত্রেই তিনি জানতেন কোন ব্যক্তি কী চায়, কার দলের উপর চাপা ক্ষোভ রয়েছে ৷ তাকেই কাজে লাগিয়ে দল ভাঙিয়ে বিজেপির সংগঠন ভারি করেছেন মুকুল ৷ অনুপম হাজরা, অর্জুন সিংয়ের মতো তাবড় তৃণমূল নেতারা দল বদলে ভোটের আগেই যোগ দিয়েছেন গেরুয়া শিবিরে ৷ শুধু নেতারাই নন, মুকুলের নেতৃত্বে ঘর বদলেছে রাজ্যের অনেক তৃণমূলস্তরের কর্মী-সমর্থক ৷
তবে নতুন দলে এসেও শুরুটা মসৃণ ছিল না মুকুলের ৷ সাংগাঠনিক কাজ নিয়ে দলের বাকি প্রবীণ গেরুয়া নেতাদের সঙ্গে সংঘাত শুরু হয় মুকুলের ৷ যদিও বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা সহ অমিত শাহও আস্থা রেখেছিলেন মুকুল রায়ের স্ট্র্যাটেজিতে ৷ দলে যোগদানের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাই বাংলায় অমিত শাহের অন্যতম সৈনিক মুকুল রায়ের ৷
২০১৯-এর বুথ ফেরত সমীক্ষায় বলে দিচ্ছে বাংলায় বিজেপির নতুন সূর্যোদয় ৷ ভোটের প্রচার পর্বে বাংলায় এসে বিজেপির সাফল্যের যে জয়গাথা মোদি-শাহরা বলে গিয়েছেন তা বহু আগেই ছকে ফেলেছিলেন মুকুল রায় ৷ বাংলায় বিজেপির এমন অভাবনীয় ফলের ইঙ্গিত কয়েকমাস আগেই মিলেছিল মুকুলের কথায় ৷ তখনই তিনি জানিয়েছিলেন তৃণমূলের আরও ১০০ বিধায়ক ও বেশ কয়েকজন নেতা ফোনে মুকুল রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন এবং দল ছাড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন ৷
মিশন বাংলার লক্ষ্যে সিংহভাগই সফল বিজেপি ৷ এবার টার্গেট ২০২১ ৷ বাংলা জুড়ে ঘাসফুলের বদলে পদ্মফুল ফোটানোর দায়িত্ব আরও একবার অমিত শাহ তুলে দিতে চলেছেন এই নির্ভরযোগ্য সৈনিক মুকুল রায়ের হাতেই ৷ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিজেপির এই ভাল ফল প্রভাব ফেলবে তৃণমূলে ৷ আরও স্পষ্ট হবে বিভাজন ৷ জোড়াফুল শিবিরের ভাঙনে আরও ঘর ভরতে চলেছে বিজেপির ৷ তৃণমূল ভাঙিয়ে আনা সংগঠনের হাত ধরেই কি রঙ বদলাবে বাংলা? ২০২১-এর বিধানসভা ভোটই দেবে উত্তর ৷