Poila Baisakh: রক্তে রাঙানো বৈশাখী ভোট, হিংসার আমেজে বাঙালির এক পয়লা বৈশাখ...
- Published by:Suman Biswas
- news18 bangla
Last Updated:
মৃত্যু ও বিষণ্ণতায় ঘেরা একটি জীবনের কাছে নতুন ভাবে বেঁচে ওঠার প্রতিশ্রুতি নিন। এই পয়লা বৈশাখে এটুকু প্রতিশ্রুতি আমরা নিজেদের কাছে করতে পারি না? একদিনের জন্যেও জীবনকে করতে পারি না কবিতার মতো?
কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল। ভোর সাড়ে চারটে। ডাক্তাররা বলে দিলেন, লড়াই শেষ। নন্দীগ্রামের প্রত্যন্ত বয়ালে যখন খবরটা পৌঁছল, তখনও পুরো আলো ফোটেনি আকাশে। অন্ধকারে মুড়ে গেল একটা বাড়ি, কান্নার রোল উঠল। পাড়া-প্রতিবেশীরা বুঝলেন, আর ফিরল না ছেলেটা। ২৭ মার্চ মার আর প্রচন্ড মারে আহত হয়েছিলেন। তারপর থেকে ঠিকানা ছিল এসএসকেএম। ঠিক চোদ্দ দিনের ভোরে, ৯ এপ্রিল শেষ শ্বাসটা নিলেন রবীন মান্না। তৃণমূল কর্মী। অভিযোগ, বিজেপি মেরেছিল। নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী, ঘটনাচক্রে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং হাজির হয়েছিলেন আহত কর্মীর বাড়িতে। হ্যাঁ, তখনও আহত ছিলেন রবীন। সেই সময়ই মমতার সামনে নিজের শাড়ির আঁচল পেতে রবীনের স্ত্রী বলেছিলেন, 'স্বামীকে ভিক্ষে চাইছি, ফিরিয়ে দিন ওঁকে।' ফেরানো যায়নি, 'ভিক্ষে' পাননি রবীনের স্ত্রী। বেঁচে থাকলে প্রতিবারের মতো এবারও পয়লা বৈশাখে স্ত্রী'কে একটা শাড়ি কিনে দিতেন রবীন।

ভোটের লাইনে প্রথমবার। উত্তেজনা কী কম! বাড়িতেও বলে এসেছিল, ভোট দিয়েই ফিরবে ও। তাতাপোড়া রোদ উঠেছে শীতলকুচির শালবাড়িতে। ২৮৫ নম্বর বুথে তখন লাইন পড়ছে ভালোই। হঠাৎই গণ্ডগোল। তারপরই ফটাশ.... গুলির শব্দ আপাত-নিরীহ শালবাড়িতে। হঠাৎই বুথের অদূরে লুটিয়ে পড়ল বছর আঠারোর ছেলেটা। সোজা হাসপাতাল। তাড়াতাড়িই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তবে ডাক্তাররা দেখে বললেন, 'বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে।' আনন্দ বর্মণ। হাসপাতালের স্ট্রেচারে শোওয়া নিথর দেহের মালিক। পরিবার বিজেপি সমর্থক। গুলি চালানোয় অভিযুক্ত তৃণমূল। বাড়িতে যখন খবর এল আনন্দ আর নেই, বর্মণ বাড়ির চৌহদ্দিতে যেন চিরতরে ছেয়ে গেল দুঃখের আস্তরণ। ছেলেটার দুপুরের খাওয়াটা পর্যন্ত হল না, বলতে-বলতে বারবার সংজ্ঞা হারাচ্ছিলেন আনন্দর মা। আজও থামেনি সেই ডুঁকরে কাঁদার আওয়াজ। বেঁচে থাকলে প্রতিবারের মতো এবারও পয়লা বৈশাখে আনন্দকে একটা জামা কিনে দিতেন বাবা।
advertisement
advertisement

ভোট চলছে বাংলায়। কালের নিয়মেই আরও একটা পয়লা বৈশাখও এল বাংলায়। বৈশাখী সূচনায় লক্ষ্মী-গণেশ, হালখাতা, সাহা জুয়েলার্সের মিষ্টির প্যাকেট-ক্যালেন্ডারের দিন ফেলে এসে, সেই কবে থেকে 'সাবালক' হওয়ার পথে এগোচ্ছে বাঙালি। 'ওহ্...'তে অফার, '....প্লেসে' পিস খুঁজে পাওয়ার মধ্যে পয়লা বৈশাখী আমেজে অভ্যস্ত হচ্ছে বাঙালি। আজকালকার দিনে সোশ্যাল মিডিয়ার যাদুকরিতে যে কোনও 'ইভেন্টের' আগেভাগেই একটা 'ফিল' তৈরি হয়ে যায়। রান্না হওয়ার আগেই যেন গন্ধ আসে নাকে। এবারও আসছে। করোনার কামড়ের মাঝেও আসছে। কিন্তু সেই গন্ধটাকে যেন চিড়ে ভেদ করে দিচ্ছে বারুদের গন্ধ। ভয়, অবিশ্বাস, ভাই-বন্ধুর মতো সম্পর্কে ভাঙন, 'ধুর মশাই আপনি কিছু জানেন না' ধরনের আত্মশ্লাঘা, 'ঘরের মেয়ে-সোনার ছেলের' আবহে আরও একটা 'নববর্ষে' পা রাখছে বাঙালি। 'নতুন বছর, নতুন আশা, তারই নাম ভালোবাসা' এখন অতীত, আগা-'পাঁচতলা' পুরোটাই এখন ক্রোধ, দেখে নেওয়ার-বুঝে নেওয়ার হিসেব-খাতা, এ যেন নতুন 'হালখাতা'-কটা লাশ পড়ল? 'সরকার, দো, তিন, চার......'
advertisement

সুমন চাটুজ্জে (অধুনা কবীর সুমন) সেই কবে লিখেছিলেন, 'বৈশাখী ঝড়ে আমি তোমাকে চাই'। সুমন শোনা, সুমন না শোনা বাঙালি এখন বোধহয় সেই বৈশাখী ঝড়ের মধ্যে দিয়েই হাঁটছে। শুধু 'তোমার' জায়গায় খুঁজে নিচ্ছে হিংসাকে, ক্ষমতার লোভকে। আমফানে ডুবে যাওয়া, বুলবুলে টিকে থাকা বাঙালির কাছে তাই এখন নতুন অধ্যায়, ভোটের ঝড়। যে ঝড়ে বাড়ির চাল হয়ত উড়ছে না, ছিঁড়েফুঁড়ে রেখে দিচ্ছে হৃদয়, কাছের মানুষটাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে কোন অজান্তে-আনন্দ বা রবীনের মতো। বীরভূমে বোম আর গোয়ালতোড়ে গুলির আওয়াজ মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে। পক্ষ আর প্রতিপক্ষ বেছে নিতে-নিতেই বাঙালির কাছ থেকে যেন হারিয়ে যাচ্ছে পয়লা বৈশাখ, নতুন স্যান্ডো গেঞ্জি, ঘরের নতুন পর্দা কেনার গল্পগাছা। কোনও এক বদ্ধভূমি থেকে যেন প্রশ্ন ছুটে আসছে, 'তুমি কি তৃণমূল, না বিজেপি, না বাম?' হাতে-হাত ধরা বাঙালির পয়লা বৈশাখ, তুমি কোথায় গেলে?
advertisement

ভোট আসবে, যাবে, পয়লা বৈশাখও। 'আধুনিকতার' সবটুকু শুষে নিয়ে হয়ত পয়লা বৈশাখও কোনওদিন পাকাপাকিভাবে 'Happy Bengali New Year'ও হয়ে উঠবে। সাহা জুয়েলার্সে ঝাঁপ পড়ে যাবে, মনোতোষ দা'র জেরক্স-এর দোকানে আর লোক আসবে না, তবু পয়লা বৈশাখ আসবে। কিন্তু সেই বৈশাখেও কি মিশে থাকবে অবিশ্বাস, রাজনীতির জাঁতাকলে পিষে যাওয়া সম্পর্ক-বিচ্ছেদের অভিমান? লোকাল ট্রেনের গ্রুপে আর কি কেউ আগের রাতের পাঁচ প্যাকেট মিষ্টি থেকে দু'টো প্যাকেট নিয়ে আসবে ইয়ার-দোস্তের জন্য? রাতের পেটপুজো সেরে ফেরার পথে পাড়ার মোড়ের আলতাফ ভাইকে কি কেউ জিজ্ঞেস করবে, 'পয়লা বৈশাখে তো আজ জবরদস্ত বেচাকেনা! বাড়ি ফিরবে কখন?'
advertisement

কত বাড়িতে সুখ ফুরোল, কত ঘরে কান্না এল। পয়লা বৈশাখও যে এল। তাতে কার কী এসে গেল! এখন তো ক্ষমতা দখলের লড়াই চলছে, লাশ পড়ছে, রক্ত দেখে প্রতিশোধস্পৃহা বাড়ছে, 'এবার আমরা এলে তোদের দেখে নেব'র হিসেব-খাতা লেখা হচ্ছে, পালটা হুঁশিয়ারিও চলছে, আরও কত কী যে চলছে, আসলে ভোট চলছে। বাঙালির 'বদলে' যাওয়া বৈশাখের পয়লা ভোর আসছে। নতুন ভোর, নতুন স্বপ্ন। সত্যিই কি নতুন? আশির দশকের কবি সুমিতেশ সরকার 'নাছোড় কর্কটরোগের মুখোমুখি'তে 'সাদা অ্যাম্বুলেন্স' কবিতায় লিখেছেন, 'ভালো থাকা ও না-থাকার মাঝখান দিয়ে এক-একটা পয়লা বৈশাখ চলে যাচ্ছে/ সকালবেলার দোয়েলপাখি চলে যাচ্ছে, সাদা অ্যাম্বুলেন্স চলে যাচ্ছে........./ ভালো থাকা ও না-থাকার মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া এক-একটি পয়লা বৈশাখ/ সকালবেলার দোয়েলপাখি, সাদা অ্যাম্বুলেন্স…' এই কবিতায় পয়লা বৈশাখ নিছক কোনও একটি দিন নয়, মৃত্যু ও বিষণ্ণতায় ঘেরা একটি জীবনের কাছে নতুন ভাবে বেঁচে ওঠার প্রতিশ্রুতিও বটে! এই পয়লা বৈশাখে এটুকু প্রতিশ্রুতি আমরা নিজেদের কাছে করতে পারি না? একদিনের জন্যেও জীবনকে করতে পারি না কবিতার মতো?
advertisement
সুমন বিশ্বাস
Location :
First Published :
April 14, 2021 7:07 PM IST