কলকাতা : কোনও এক সময় কলকাতা ছিল এই বাড়িকে ঘিরেই ৷ কলকাতার দুর্গোৎসবও আবর্তিত হত এই বাড়ির ঠাকুরদালানকে ঘিরেই ৷ বনেদি এই পরিবারের গৃহদেবতা কিন্তু শাক্ত দেবী দশভুজা নন, সেখানে শোভা পান গোবিন্দ জীউ ও গোপীনাথ জীউ ৷ শ্রীকৃষ্ণের এই অবতার রাজবাড়িতে সেই ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে পূজিত হয়ে আসছেন জগন্নাথ মহাপ্রভু রূপে ৷ জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমায় যে তিথিতে শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা হয়, সেদিন এ বাড়ির গৃহদেবতারও স্নানাভিষেক হয় ৷
কথিত, জ্যৈষ্ঠের তীব্র দাবদাহ থেকে গৃহদেবতাকে মুক্তি দিতেই এই পার্বণের আয়োজন ৷ কোনও কোনও বছর এই পার্বণ পালিত হয় আষাঢ়েও ৷ যেমন এ বছর হল৷ বৃহস্পতিবার, ৯ আষাঢ় স্নানযাত্রা হল গোবিন্দ জীউ ও গোপীনাথ জীউয়ের ৷ সনাতন রীতি ও ঐতিহ্য পালন করে গৃহদেবতার বিগ্রহকে এ দিন অর্চনা করা হয় দুধ, ঘি, মধু, গোচনা, গোময়, আখের রস, গোলাপজল, কেওড়াজল, অগুরু-সহ অন্যান্য উপকরণ সহকারে ৷ এর পর ১০৮ ঘটি গঙ্গাজল বিগ্রহের উপর বর্ষিত হয় সহস্রঝারা এবং দক্ষিণাবর্ত শঙ্খের মাধ্যমে ৷ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হয় এই পুণ্যস্নান ৷
রাজা নবকৃষ্ণ দেবের উত্তরসূরিদের আজ দু’টি তরফ ৷ দীর্ঘ দিন অপুত্রক থাকায় তিনি দত্তক নিয়েছিলেন অগ্রজপুত্র গোপীমোহনকে ৷ গোপীমোহন দেবের বংশধররা পরিচিত বড় তরফ বলে ৷ এর পর প্রায় জীবন-উপান্তে পৌঁছে পুত্রসন্তানের পিতা হন রাজা নবকৃষ্ণ ৷ ছেলের নামকরণ করা হয় রাজকৃষ্ণ ৷ যেহেতু তিনি ছিলেন অনুজ, তাই রাজকৃষ্ণ দেবের উত্তরসূরিরা আজ পরিচিত ছোট তরফ বলে ৷ তাঁদের আরাধ্য গৃহদেবতা গোপীনাথজীউ ৷ বড় তরফে পূজিত হন গোবিন্দ জীউ ৷ দুই তরফের গৃহদেবতাই পূজিত হন স্নানযাত্রায় ৷
বড় তরফে স্নানযাত্রা ও হোম
ছোট তরফের সদস্য তীর্থঙ্করকৃষ্ণ দেব জানালেন, ‘‘১৭৫৭ থেকে এই স্নানযাত্রা পার্বণ পালিত হয়ে আসছে ৷ তবে পুরীতে এর পর জগন্নাথদেব একপক্ষকাল অদর্শনে থাকেন ৷ আমাদের দুই তরফের গৃহদেবতা কিন্তু দর্শন দেন ৷ তাঁদের নিত্যপুজো চলে নিয়ম মেনেই ৷’’গৃহদেবতার নিত্যসেবা আজও এ বাড়িতে রাজকীয়ই ৷ রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সময় থেকে এখনও বৈশাখ মাসে গৃহদেবতাকে ‘ঝারা’ দেওয়ার রীতি পালিত হয়ে আসছে ৷ শীতল জলে সিক্ত করা হয় গৃহদেবতাদের এবং নারায়ণ শিলাকে ৷ শরীরকে ঠান্ডা রাখার জন্য শ্রীবিষ্ণু ও পঞ্চদেবতাকে উৎসর্গ করা হয় ফলের নৈবেদ্য ৷ চার দেবদেবীর প্রত্যেককে আলাদা করে মোট চারটি থালা নিবেদন করা হয় রোজ ৷ সেখানে থাকে মাখন, মিছরি, ডাব, পেঁপেঁ, কলা, পেয়ারা, আম, লিচু, তরমুজ, খেজুর, কিসমিস, কাজু, পেস্তা ও দই ৷ বৈশাখ মাসে পালিত হয় শীতলা অষ্টমীও ৷
প্রতি বছর বৈশাখ থেকে শুরু করে চৈত্র মাস পর্যন্ত শারদোৎসব-সহ সব পুজোপার্বণ পালন করার দায়িত্ব পড়ে পরিবারের একাংশের উপর ৷ তাকে বলা হয় পালাদার ৷ প্রাচীন নিয়মে নির্দিষ্ট করা হয়, কে হবেন পালাদার ৷ দেবসেবার ব্যয় বহনের জন্য রাধাকান্ত দেব স্থাপিত তাঁরই নামাঙ্কিত নিজস্ব এস্টেট আছে ৷ এস্টেটের অন্যান্য কাজের মধ্যে অন্যতম সম্বৎসরের দেবসেবার ব্যয়বহন ৷
গোবিন্দজী ও গোপীনাথজীর নিত্যসেবায় রোজ সকালে থাকে আতপচাল, দুধ ও কলা ৷ সন্ধ্যায় লুচি, মিঠাই চাকতি বা একপ্রকার মিঠে গজা, ক্ষীরের মিষ্টি দেওয়া হয় গৃহদেবতাকে ৷ নিত্যসেবার জন্য যে পুরোহিত থাকেন রাজবাড়িতে তাঁকে বলা হয় হয় অধিকারীমশাই ৷
স্নানযাত্রা ও তার পর রথযাত্রা থেকেই এ বাড়ির ঠাকুরদালানে দশভুজার আগমনের প্রস্তুতি শুরু ৷ সোজা রথের দিন বড় তরফে এবং উল্টোরথের তিথিতে ছোট তরফে শারদোৎসবের খুঁটিপুজো হয় ৷
গত বছর থেকে উৎসবের আনন্দ ম্লান হলেও এ বছরও সব রীতি মেনে পালিত হল গৃহদেবতার স্নানযাত্রা ও হোম ৷ সনাতন রীতির পাশাপাশি ছিল অতিমারিবিধিও ৷ সবকিছুর মাঝে সকলের মঙ্গলপ্রার্থনায় স্নানাভিষেক হল প্রাচীন বনেদি পরিবারের গৃহদেবতাদের ৷ সাক্ষী থাকল বহু ইতিহাসের ধুলোরেণু মাখা দালান ৷
(ঋণস্বীকার-হরানো দিন পুরানো কথা, প্রতীপ দেব
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্য-সৌমিত নারায়ণ দেব ও তীর্থঙ্করকৃষ্ণ দেব )
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Snanjatra, Snanyatra, Sovabazar rajbari