#কলকাতা: এককালের পুজোটা ঠিক এরকম ছিল না ৷ তখন মায়ের মুখ দেখার জন্য হাঁ করে বসে থাকতে হত মানুষগুলোকে ৷ বাবুদের দয়া-দাক্ষিণ্য হলে, দিনের একটা বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ে, মুহূর্তের জন্য দেখা পাওয়া যেত মা দুর্গার ৷ কারণ সে সময় বনেদি বাড়ির পুজোগুলোয় ঢোকার অনুমতি ছিল না সর্বসাধারণের ৷ বাড়ির আত্মীয়-স্বজন, জমিদার, রাজারাজড়া, ইংরেজদের বড় কর্তা আর বাবুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বড়বাড়ির পুজোগুলো ৷ প্রাথমিক ক্ষোভের শুরুটা হয়েছিল এখান থেকেই ৷ বঞ্চনার কষ্টটাই বদলে যায় বারেয়ারি পুজোর আনন্দে ৷কথিত আছে, বর্তমানের বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তহিরদরের সামন্তরাজ কংসনারায়ণ রায় নাকি প্রথম ধুমধাম করে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন ৷ সেটা সম্ভবত ১৫৮২ সাল ৷ এই পুজোর পিছনে একটা গল্প রয়েছে ৷ কংসনারায়ণ যে সুলতান বংশের দাক্ষিণ্যে বিপুল যশ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি পেয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সম্রাট আকবরের সহায়তায় তাঁকেই উৎখাত করেন ব্যক্তিগত স্বার্থে ৷ সে সময় তাঁর মনে গ্লানি জন্মায় ৷ প্রায়শ্চিন্ত করার সংকল্প করেন কংসনারায়ণ ৷ ডেকে পাঠান পণ্ডিতদের ৷ বলেন, ‘‘নিজেকে আমি অশুচি ও অপরাধী মনে করছি ৷ তাই কোনও একটা মহাযজ্ঞে ব্রতী হতে চাই ৷’’
সকলে এসে তখন রাজাকে বিধান দেন, দুর্গোৎসব করার ৷ মনের অনুতাপ দূর করতে দুর্গা পুজোর প্রচলন করেন কংসনারায়ণ ৷ সেই দুর্গা পুজোর সূচনা ৷ শোনা যায়, বিপুল আয়োজন আর মহা ধুমধাম করে এই পুজো করেছিলেন তিনি ৷ খরচ হয়েছিল আট লক্ষ টাকা ৷ এখানকার হিসেবে তা কয়েক কোটির কম নয় ৷ আবার অন্য একটা মত বলে, মুঘলদের বিরুদ্ধে বাংলার যে ১২ জন ভূস্বামী (বারো ভুঁইঞা) লড়েছিলেন, রাজা কংসনারায়ণ তাঁদের একজন। মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে নিজের দাপট দেখাতে তিনি মহাশক্তি দুর্গার পুজো শুরু করেন। তবে এই পুজো করার পরে যে কংসনারায়ণের সুনাম, প্রতিপত্তি, জনপ্রিয়তা কয়েকশ’ গুণ বেড়ে গিয়েছিল তা সত্যি ৷
কংসনারায়ণের দেখাদেখি ভাদুড়িয়ার ভূস্বামী জগৎ নারায়ণও নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করে বাসন্তীপুজো করলেন ৷ কিন্তু কংসনারায়ণের মতো জনপ্রিয়তা পায়নি সেই পুজো ৷ এরপর ১৬১০-এ বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের পরিবার দুর্গাপুজো শুরু করে ৷ সেটাই কলকাতার প্রথম পুজো বলে মনে করা হয় ৷ তারপর গোবিন্দরাম মিত্রের বাড়িতে বিপুল আড়ম্বড়ে শুরু হয় দুর্গাপুজো ৷ এরপর ১৭৫৭ সালে দুর্গাপুজোয় আর এক জাঁকজমক আর রোশনাইয়ের ছটা দেখল কলকাতা ৷ পলাশির যুদ্ধজয়ের বিজয় উৎসব পালন করতে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব শুরু করলেন দুর্গাপুজো ৷কিন্তু বড় বাড়ির এই সমস্ত পুজোগুলোতে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না ৷ এই সীমাবদ্ধতাই ধীরে ধীরে বারোয়ারি পুজোর রাস্তা পরিষ্কার করে দেয় ৷ কিন্তু এত বড় আর এত খরচের একটা পুজো সাধারণ মানুষ করবেন কী করে ? শোনা যায়, ১২ জন বন্ধু বা ইয়ারের মাথায় প্রথম সম্মিলিত একটা পুজো করার চিন্তা মাথায় আসে ৷ পুজোর খরচ তুলতে পাড়ার মানুষদের চাঁদাই ভরসা ৷ যেমন ভাবা তেমনি কাজ ৷ দুর্গা পুজোর ইতিহাসে পালাবদলের অধ্যায় শুরু হল ৷ সেটা ১৭৯০ সাল ৷ জায়গাটার নাম গুপ্তিপাড়া ৷ হগলি জেলার এই এলাকাই বারোয়ারি পুজোর গোড়া পত্তনের সাক্ষী ৷ শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো শুরুর ৩৩ বছর পর ১২ জন ব্রাহ্মণের হাতে শুরু হয় সর্বসাধারণের পুজো ৷ সেই পুজোই আসলে সর্বজনীন পুজো ৷
এরপর ব্যাঙের ছাতার মতো একের পর এক বংশবৃদ্ধি করতে থাকে বারোয়ারি পুজো ৷ বনেদিবাড়ির মতো শুদ্ধাচার হয়তো এই পুজোগুলোতে ছিল না, কিন্তু এই পুজোর গ্রহণযোগ্যতা ছিল কয়েকশ গুণ বেশি ৷ আস্তে আস্তে এই পুজোয় এল নাটক, যাত্রাপালা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ৷ পাশাপাশি, গোটা পাড়ার মানুষদের হৈ-হুল্লোড়, আনন্দে-কলোরবে মেতে উঠল বারোয়ারী পুজোর প্রাঙ্গন ৷ উনিশ শতকের গোড়া থেকেই সারা কলকাতায় ছিটিয়ে পড়ল এই পুজো ৷ ১৯১০ সালে শুরু হল ভবানীপুরের সনাতন ধর্মীয়সভার পুজো ৷ শ্যামপুকুর সর্বজনীনের পুজো শুরু হয় এর ঠিক এক বছর পর ৷ ১৯১৩ সালে শুরু হল শিকদার বাগান সর্বজনীনের পুজো ৷ বাগবাজার সর্বজনীন ১৯১৯ সালে ৷ শিমলা ব্যয়াম সমিতির পুজোর শুরু ১৯২৬-এ ৷আজ জাঁকজমক আর বৈভবে বাড়ির পুজোর থেকে কোনও অংশে কম যায় না বারোয়ারি পুজোগুলো ৷