বয়সে বড় তুতো দিদি’কে বিয়ে করেছিলেন সত্যজিৎ, লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল সেই বিয়ে! সে-ও কম বিপ্লব নয়

Last Updated:

সারাটা জীবন ধরে স্বামীর প্রতিটি তালে-বোলে-ঠুমরিতে যথাযথ সঙ্গত করে যিনি মহান ওই মানুষটির জ্যোতি আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বিজয়া রায় ।

#কলকাতা: বিপ্লবই তো । ‘ঘরে বাইরে’ সেই বিপ্লবের প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন নিজেদের ‘পথের পাঁচালি’তেও । বাঙালির শ্রেষ্ঠ চিত্র পরিচালক হয়ে একদিকে যেমন জয় করেছেন গোটা বিশ্ব, অন্যদিকে বিপ্লবের বীজ পুঁতেছিলেন ঘরকন্নার ছোট্ট পরিসর থেকেই । আর সেই ঘরকন্নাকে যিনি সব দিক দিয়ে সফল করেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, সত্যজিৎ জায়া, প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তির যোগ্য সহধর্মিনী বিজয়া রায় । যথার্থ অর্থেই মাণিকের অর্ধাঙ্গিনী ছিলেন মঙ্কু । সে পথের পাঁচালির শ্যুটিং টাকার অভাবে আটকে যাওয়ার পর গায়ের গয়না খুলে দেওয়াই হোক, আর কিশোর কুমারকে রবীন্দ্র সঙ্গীত রেকর্ড করে পাঠানোই হোক বা অপুর সংসারের জন্য শর্মিলা ঠাকুরকে স্বামীর মনের মতো অপর্ণায় পরিণত করাই হোক । সারাটা জীবন ধরে স্বামীর প্রতিটি তালে-বোলে-ঠুমরিতে যথাযথ সঙ্গত করে যিনি মহান ওই মানুষটির জ্যোতি আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বিজয়া রায় ।
নিজের থেকে বয়সে ছোট পিসতুতো ভাই’কে ভালবেসে বিয়ে করতেও পিছপা হননি তিনি। পঞ্চাশের দশকে দাঁড়িয়ে এমন কাজ করতে কিন্তু বুকের পাটা লাগে । কিন্তু তাঁর নামও বিজয়া রায় । একদিকে প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব, অন্যদিকে অপার সমর্পণ, একদিকে প্রবল প্রতিভা, অন্যদিকে অসীম ত্যাগ, একদিকে মমতা ঢালা হৃদয়ে করুণার সাগর, উল্টোদিকে অসম্ভব স্পষ্টবক্তা... মিঠে-কড়ায় তাঁর চরিত্র হয়ে উঠেছিল অনন্ত সুন্দর । যাঁর প্রেমে না পড়ে ছাড় পাননি স্বয়ং সত্যজিৎও ।
advertisement
advertisement
বিজয়ার জন্ম অক্টোবর ১৯১৭ । বাবার নাম ছিল চারুচন্দ্র দাস । পটনার নামজাদা ব্যারিস্টার ছিলেন তিনি । মায়ের নাম মাধুরী দেবী, তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর ছোট বোন। পটনার প্রসিদ্ধ ব্যারিস্টারের মেয়ে বিজয়া ছিলেন অসামান্যা রূপসী আর গুণবতী । কন্ঠস্বরে যেন ছিল মধু মাখা । বিত্তবান বাবা শুধু গান শেখাতেই মেয়েকে পাঠাতে চেয়েছিলেন প্যারিস । কিন্তু বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে মুহূর্তে ভেঙেচুরে যায় সব স্বপ্ন । সে সময় বিধাতা পুরুষ তখন মুখ টিপে হেসেছিলেন ।
advertisement
অসহায়, সম্বলহীন মাধুরী দেবী ছেলে-মেয়ে নিয়ে উঠে আসেন কলকাতায় শ্বশুরের ভিটেতে । কালক্রমে সেই সময় অকাল বিধবা হয়ে সুকুমার জায়া সুপ্রভা রায়ও বাপের বাড়িতে এসে ওঠেন একমাত্র ছেলে সত্যজিৎকে নিয়ে । সেখানেই আলাপ দু’জনের । সত্যজিৎ আর বিজয়া । ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, ভালবাসা । একে অপরের মধ্যে পূর্ণতা খুঁজে পাওয়া । কিন্তু বিয়ে যে প্রায় অসম্ভব । তবু পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলেন তাঁরা । ১৯৪৮-এর ২০ অক্টোবর তৎকালীন বোম্বে-তে সকলকে লুকিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেন সত্যজিৎ-বিজয়া । ১৯৪৯-এর ৩ মার্চ ফের কলকাতায় ব্রাহ্ম মতে বিয়ে হয় । সামাজিক প্রয়োজনেই রেজিস্ট্রি বিয়ের কথা গোপন করে রেখেছিলেন তাঁরা । বিজয়া রায় এ-প্রসঙ্গে তাঁর আত্মজীবনীতে পরিহাস করে লিখেছিলেন, ‘যেখানে একবার বিয়ে হওয়ারই কোনও সম্ভাবনা ছিল না, সেখানে দু’বার হল।’
advertisement
‘রিভার’ ছবির সময়েও জঁ রেনোয়া সত্যজিৎ রায়কে তাঁর ছবি উপহার দিয়ে লিখেছিলেন, ‘মানিক রায়কে, যাঁকে বিবাহিত দেখলে খুশি হব। ’
সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিকূলতার চাপে তাঁরা যে কী ভাবে প্রথম কয়েক মাস নিজেদের রেজিস্ট্রির কথা চেপে রেখেছিলেন, রেনোয়া তা জানতেন না।
advertisement
এরপর থেকে বিজয়া সবদিক থেকেই হয়ে উঠেছিলেন এক বিশ্ব বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সুযোগ্য গৃহিণী । অসম্ভব শৌখিন ছিলেন বিজয়া রায় । বিশপ লেফ্রয় রোডের বিখ্যাত সেই বাড়িকে একেবারে সত্যজিতের পছন্দের মতো করে সাজিয়েছিলেন । সৌন্দর্য্যবোধ তাঁর ছিল এতটাই পরিমিত যে, স্বয়ং সত্যজিৎও সেট ডিজাইনিংয়ের অনেকক্ষেত্রেই তাঁর প্রিয় মঙ্কুর উপর ভরসা করতেন । সত্যজিতের নায়িকাদের সাজিয়ে তোলার বেশিরভাগ দায়িত্বও বর্তেছিল বিজয়ার উপর । তিনি ছিলেন খুদে অভিনেতাদের আদরের মঙ্কুমাসি । ‘জলসাঘর’ হোক বা ‘চারুলতা’, সেটের অধিকাংশ প্রপ নিজের সংগ্রহ থেকেই সাজিয়ে দিতেন তিনি । বুনতে পারতেন অসাধারণ । তাঁর হাতের রান্না আর লেসের কাজ, যে-ই দেখত চোখ ফেরাতে পারত না । আর ছিল পারফিউমের শখ । দেশে-বিদেশে গেলেই স্যুটকেসে ভরে আনতেন সেগুলো । ছিল সকলকে উপহার দেওয়ার নেশা । কিন্তু যেমন তেমন ভাবে নয় । প্রতিটি উপহারের সঙ্গে নিজে হাতে দারুণ সব নক্সা কেটে সেগুলি র‍্যাপিং করতেন ৷ জানতেন দেশ বিদেশের নানা রকম রান্না ৷ লিখে রাখতেন সে সব ৷ তাঁর হাতের বেকিং এমন অসাধারণ ছিল যে, একবার খেলে সে স্বাদ ভোলা যেত না ৷ নিজে সাজতেন না, কিন্তু সাজাতে পারতেন চমৎকার ৷
advertisement
‘অপুর সংসার’-এর লুক টেস্টের সময় শর্মিলাকে এক্কেবারে স্বামীর মনের মতো করে অপর্ণা সাজিয়ে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন । যা দেখে এক চান্সেই সম্মতি দিয়ে দিলেন ‘দ্য গ্রেট রে’ । শুধু কী এই? বাংলা, ইংরাজি সাহিত্য, পাশ্চাত্য মিউজিক আর দেশি বিদেশি সমস্ত ধরনের গোয়েন্দা গল্প নিয়ে পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ । সত্যজিতের প্রতিটি সুর, গল্প, উপন্যাস, স্কেচ, চিত্রনাট্যের প্রথম পাঠক ছিলেন বিজয়া রায় । তাঁর প্রতিটি মতামত আর পছন্দ-অপছন্দের উপর অগাধ আস্থা ছিল সত্যজিতের ।
advertisement
কিন্তু এত কিছুর পরেও সেই মানুষটির সবথেকে বড় দিক ছিল নিজেকে আড়াল করা । সর্বগুণসম্পন্না একজন বিদূষী মহিলা, যিনি নায়িকা হয়ে পর্দায় এসেছেন, গায়িকা হয়ে গান গেয়েছেন...কিন্তু বিয়ের পর শুধুই বাঁচতে চেয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী’র পরিচয়ে, রায় বাড়ির যোগ্য পুত্রবধূ হয়ে । অন্তরাল থেকে কপালে জয়টিকা পরিয়ে স্বামীকে এগিয়ে দিয়েছেন বিশ্ব জয় করতে, নিজে সামলেছেন একমাত্র ছেলে’কে, আগলে রেখেছেন এক আপনভোলা শিল্পীকে, অনুপ্রেরণা হয়ে তাঁকে শ্রেষ্ঠ করেছেন, প্রেয়সী হয়ে তাঁকে লালন করেছেন । শেষ বয়সেও, সত্যজিৎ যখন মৃত্যুশয্যায়- তখনও নার্স, আয়া কিছুই রাখেননি কোনওদিন । একা হাতে শেষদিন পর্যন্ত সেবা করেছেন পরম মমতায় । তাঁদের বন্ধন ছিল অপার-অসীম-অবিচ্ছেদ্য । একে অপরের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন মুক্তির মন্ত্র । পূর্ণ হয়েছিলেন সম্পূর্ণভাবে ।
তাই সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর শতবর্ষপূর্তিতে সেই মানুষটার কথা ছাড়া অসম্পূর্ণ এই লেখাও, যে ‘মঙ্কু’কে ছাড়া জ্যোতিহীন ছিলেন ‘মাণিক’ ।
view comments
বাংলা খবর/ খবর/ফিচার/
বয়সে বড় তুতো দিদি’কে বিয়ে করেছিলেন সত্যজিৎ, লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল সেই বিয়ে! সে-ও কম বিপ্লব নয়
Next Article
advertisement
Rhino rescue: বিপর্যয়ের সময় ভেসে গিয়েছিল তারা, অবশেষে ঘরে ফিরল ১০ গন্ডার! সফল 'অপারেশন রাইনো'
বিপর্যয়ের সময় ভেসে গিয়েছিল তারা, অবশেষে ঘরে ফিরল ১০ গন্ডার! সফল 'অপারেশন রাইনো'
  • ১৩ দিনের অপারেশন রাইনোতে ১০টি গন্ডার উদ্ধার করেছেন বনকর্মীরা

  • বিপর্যয়ের সময় জলদাপাড়া থেকে ভেসে গিয়েছিল বেশ কয়েকটি গন্ডার

  • অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বনকর্মীরা গন্ডারগুলোকে জঙ্গলে ফেরাতে সক্ষম হন

VIEW MORE
advertisement
advertisement