হোম /খবর /ফিচার /
রাণুকে কবি লিখলেন,'' তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে আমার ঠাকুর আমাকে আরও বেশি বল দিয়েছে

রাণুকে কবি লিখলেন, '' তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে আমার ঠাকুর আমাকে আরও বেশি বল দিয়েছেন''

  • Last Updated :
  • Share this:

    #কলকাতা:  রাণুর সঙ্গে যখন রবি ঠাকুরের পত্রমিতালি শুরু হয়, তখন রাণুর বয়স কবি পত্নী মৃণালিনী দেবীর বিয়ের বয়সের মতোই ছিল। বরং কবিপত্নী খানিক বড়ই ছিলেন। কবি আর রাণুর মধ্যে ছিল পয়ঁতাল্লিশ বছরের ব্যবধান! কিন্তু তাঁদের গভীর বন্ধুত্বে বয়সের ফারাক কখনও কোনও সমস্যা তৈরি করেনি। সালটা ১৯১৮ ! রবি ঠাকুর শান্তিনিকেতন থেকে রানুকে চিঠি লিখলেন...

    খুব বেদনার সময় তুমি যখন তোমার সরল এবং সরস জীবনটি নিয়ে খুব সহজে আমার কাছে এলে এবং এক মুহূর্তে আমার স্নেহ অধিকার করলে তখন আমার জীবন আপন কাজে বল পেলে-- আমি প্রসন্ন চিত্তে আমার ঠাকুরের সেবায় লেগে গেলুম। কিন্তু তোমার প্রতি এই স্নেহে যদি আমাকে বল না দিয়ে দুর্বল করত, আমাকে মুক্ত না করে বদ্ধ করত তাহলে আমার প্রভুর কাছে আমি তার কী জবাব দিতুম?... তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে আমার ঠাকুর আমাকে আরও বেশি বল দিয়েছেন। তুমিও তেমনি বল পাও আমি কেবল এই কামনা করছি। তোমার ভালবাসা তোমার চারদিকে সুন্দর হয়ে বাধামুক্ত হয়ে ছড়িয়ে যাক--তোমার মন ফুলের মতো মাধুর্যে পবিত্রতায় পূর্ণ বিকশিত হয়ে তোমার চতুর্দিকে আনন্দিত করে তুলুক।...আমি তোমাকে যখন পারব চিঠি লিখব--কিন্তু চিঠি যদি লিখতে দেরি হয়, লিখতে যদি নাও পারি তাতেই বা এমন কী দুঃখ। তোমাকে যখন স্নেহ করি তখন চিঠির চেয়েও আমার মন তোমার ঢের বেশি কাছে আছে।

    মাত্র ১১ বছরের রাণুর রবীন্দ্রাণুরাগ কবিকে অভিভূত করেছিল। কবিকে লেখা তাঁর প্রথম চিঠিতে রাণু লিখেছিলেন,

    '' প্রিয় রবিবাবু। আমি আপনার গল্পগুচ্ছের সব গল্পগুলো পড়েছি, আর বুঝতে পেরেছি। কেবল ক্ষুধিত পাষাণটা বুঝতে পারিনি।... আচ্ছা জয়পরাজয় গল্পটার শেষে শেখরের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হল। না? কিন্তু আমার দিদিরা বলে শেখর মরে গেল। আপনি লিখে দেবেন যে, শেখর বেঁচে গেল আর রাজকন্যার সঙ্গে তার বিয়ে হল। কেমন? সত্যিই যদি শেখর মরে গিয়ে থাকে, তবে আমার বড় দুঃখ হবে। আমার সব গল্পগুলোর মধ্যে মাস্টারমশায় গল্পটা ভালো লাগে। আমি আপনার গোরা, নৌকাডুবি, জীবনস্মৃতি, ছিন্নপত্র, রাজর্ষি, বৌঠাকুরাণীর হাট, গল্পসপ্তক সব পড়েছি। আপনার কথা ও ছুটির পড়া থেকে আমি আর আর আমার ছোট বন কবিতা মুখস্থ করি। চতুরঙ্গ, ফাল্গুনী ও শান্তিনিকেতন শুরু করেছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম না। ডাকঘর, অচলায়তন, রাজা, শারদোৎসব এসবও পড়েছি। আমার আপনাকে দেখতে খু-উ-উ-উ-উ-উ-উব ইচ্ছে করে।''

    শেষের কবিতা লেখার পাঁচ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং এসেছিলেন। বয়স তখন ৬২। কিন্তু তিনি সত্যিসত্যিই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, বয়সের মাপকাঠিতে নয়, 'দুর্লভ যুবকত্ব নির্জলা যৌবনের জোরেই...।''

    ১৯২৩-এ 'নির্জলা যৌবনের' অধিকারী 'ছাব্বিশ'-এর রবীন্দ্রনাথ অমিতের মতোই, শিলং-এর পথে পথে ঘুরেছিলেন এক সপ্তদশী সুন্দরীকে সঙ্গে নিয়ে। মেতেছিলেন গল্পে, কৌতুকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা দুজনকে অসমবয়সি মনে করলেও, কবির ভ্রমণসঙ্গিণীর কাছে তিনি ছিলেন 'সাতাশ' বছরের তরুণ! কবি ঠাট্টা করে বলতেন, 'সাতাশ'কে লোকে 'সাতাশি' শুনবে, বরং 'ছাব্বিশ' ভাল! অনেকে বলেন, শিলং পাহাড়ে কবির সেই ভ্রমণসঙ্গিণীর নাম ছিল রাণু-- রাণু অধিকারী। তবে, এটা হলফ করে বলা যায় না! কিন্তু মিল রয়েছে অনেক।

    আমিত্রসুদন ভট্টাচার্য তাঁর 'রবীন্দ্রনাথ রাণু ও শেষের কবিতা'য় এমন কিছু সাদৃশ্যে তুলে ধরেছেন। যেমন, রাণু ও লাবণ্য, দুজনেই রবি ঠাকুরের প্রতি অনুরক্ত। পোশাক-আসাকেরও মিল রয়েছে অনেক। শেষের কবিতা লেখা সময় কবি বলেছেন, লাবণ্য তাঁর খুব চেনা। দু'জনের বাবার একই পেশা। লাবণ্যর বাবা অবিনাশ দত্ত এক পশ্চিমি কলেজের অধ্যক্ষ, রাণুর বাবা ফণিভূষণ অধিকারি ছিলেন দিল্লির হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ।

    শোভনলালের সঙ্গে যেমন লাবণ্যর, তেমনি আট বছরের সম্পর্কর শেষে রাণুরও বিয়ে হয়ে যায় শিল্পপতি পুত্র বীরেন্দ্রর সঙ্গে। শেষের কবিতার সমাপ্তি যেমন, কেটির সঙ্গে অমিতের এবং লাবণ্যর সঙ্গে শোভনলালের আসন্ন বিয়ের খবর দিয়ে, তেমনি রাণু-রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে যে জীবন-উপন্যাস, তারও সমাপ্তি রাণুর বিয়ের সম্ভাবনার সংবাদেই!

    অমিত-লাবণ্যর প্রেম গড়ে উঠেছিল শিলং পাহাড়ে। আবার এই শিলং পাহাড়েই রাণুকে খুব কাছ থেকে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। টানা প্রায় দেড়মাস, শিলং-এর 'জিৎভূমি' বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ শিলং-এ এসেছিলেন মোট তিনবার। ১৯১৯, ১৯২৩ ও ১৯২৭। দ্বিতীয়বারের সঙ্গী রাণু। তাঁর বিয়ে হয় ১৯২৫-এ। ১৯২৭-এ শিলং-এ এসে রবি ঠাকুর রাণুকে লিখলেন, ''রাণু, শিলঙে এসে পৌঁছেছি। কিন্তু এ আর এক শিলং।''

    First published:

    Tags: Lady Ranu, Rabindranath birthday special, Rabindranath letter to ranu, Rabindranath Tagore