#কলকাতা: পলাশীর যুদ্ধের পর পরই কলকেতায় সাহেবদের নিজ ভবনে নেমন্তন্ন করে ফূর্তির ফোয়াড়া ছোটানো শুরু করল রাজরাজরা, জমিদারের দল। সাহেবসুবোদেরও এইসব নব্যবাবু বা 'জেন্টু'দের আমন্ত্রণে মুখে লাল গড়াত! এক কথায়, মায়ের দয়ায় মোচ্ছব!
শোনা যায়, দিল্লির আকবর বাদশাহের সময় বাংলার রাজশাহি জেলার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলায় প্রথম দুর্গা পুজোর প্রচলন করেছিলেন। এই পুজোকে জনসাধারণের মধ্য জনপ্রিয় করেছিলেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭২৮ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আসার পর প্রথম দুর্গা পুজো করেন। হুতোম তাঁর 'দুর্গোৎসব' নকশাতে লিখেছেন-- '' বোধ হয়, রাজা কৃষ্ণচন্দরের আমল হতেই বাঙ্গালায় দুর্গোৎসবের প্রাদুর্ভাব বাড়ে, পূর্ব্বে রাজারাজড়া ও বনেদী মানুষদের বাড়িতেই কেবল দুর্গোৎসব হত।''
গ্রাম-কলকাতায় দুর্গোৎসব হত। ১৯৬৮ সালে সুতানটি-কলকাতা- গোবিন্দপুর-- এই তিনটে গ্রাম ইংরেজ কোম্পানির হাতে আসার পর থেকে পলাশীর যুদ্ধের সময় পর্যন্ত দেশীয় কোনও দুর্গোৎসবে সাহেবরা সোৎসাহে যোগদান করেছেন, এমনটা শোনা যায়নি। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের বছর থেকে নবকৃষ্ণ দেববাহাদুরের হাত ধরেই শুরু হল দুর্গোৎসবে সাহেবি-আনন্দ।
মহারাজ নবকৃষ্ণদেব তাঁর কোনও এক বন্ধুকে দুর্গা পুজোয় নিমন্ত্রণ করেছিলেন যে ব্যক্তিগত চিঠি লিখে, সেখানে তিনি লিখেছিলেন, '' এবার পুজোর সময় লর্ড ক্লাইভ আমার বাটিতে অনুগ্রহপূর্বক প্রতিমা দর্শন করিতে আসিবেন। তাঁহার সহিত কোম্পানির বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকিবেন। তোমার আসা চাই।''
১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে 'বঙ্গদূত' পত্রিকায় একটি খবর বেরিয়েছিল--'' মহারাজ নবকৃষ্ণ বাহাদুরের দুই বাটিতে নবমীর রাত্রে শ্রীশ্রীযুত গভরনর জেনেরল লর্ড বেন্টিঙ্ক বাহাদুর ও প্রধান সেনাপতি শ্রীশ্রীযুত লর্ড কম্বরীর ও প্রধান ২ (প্রধান) সাহেব লোক আগমন করিয়াছিলেন। তাঁরা রাত 'দুই দণ্ড পর্য্যন্ত নানা আমোদ ও নৃত্যগীতাদি দর্শন ও শ্রবণ করত অবস্থিতি করিয়া প্রীত হইয়া গমন করিলেন।''
সাহেবদের মনোরঞ্জনের উপাদানে কোনও খামতি থাকত না। নাচ-গান থেকে ইংরেজি খানা-পিনা... সবেরই আয়োজন থাকত।
ফ্যানি পার্কস ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার দুর্গোৎসব দেখে দেবীর বর্ণনা দিয়েছিলন-- '' সেদিন দুর্গাপূজা দেখতে গিয়াছিলাম একজন ধনিক বাঙালীবাবুর বাড়ি। 'দুর্গা' নামে হিন্দুদের যে দেবী আছেন তাঁরই 'অনারে' এই উৎসব হয়। বাবুর চারমহলা বাড়ি, মধ্যিখানে বিরাট উঠোন। সেই উঠোনের এক পাশে উঁচু মঞ্চের উপর দেবী দুর্গার সিংহাসন পাতা। সিংহাসনের উপর দুর্গার মাটির প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত। মঞ্চের দু'ধারে সিঁড়িতে ব্রাহ্মণেরা উপনিষ্ট, পূজার অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। প্রতিমার ডানহাত দিয়ে তিনি এক ভীষণাকৃতি অসুরকে বর্শাবিদ্ধ করেছেন, বামহাতে একটি বিষাক্ত সাপের লেজসহ অসুরের ঝুঁটি ধরেছেন, সাপটি অসুরের বক্ষস্থল দংশন করছে। বাকি আটটি হাত ডাইনে-বামে প্রসারিত, প্রত্যেক হাতে একটি করে মরণাস্ত্র। তাঁর দক্ষিণ হাঁটুর কাছে একটি সিংহ এবং বাম হাঁটুর কাছে অসুর। সিংহ দেবীকে বাহন করেছে মনে হয়।''
পুজোয় সাহেব-সুবোদের ভোজ নিয়েও লেখেন ফ্যানি পার্কস-- '' পূজামণ্ডপের পাশের একটি বড় ঘরে নানারকমের উপাদেয় সব খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে সাজানো ছিল। সবই ইয়োরপীয় অতিথিদের জন্য বিদেশী পরিবেশক 'মেসার্স গান্টার অ্যান্ড হুপার' সরবরাহ করেছিলেন। খাদ্যের সঙ্গে বরফ ও ফরাসী মদ্যও ছিল প্রচুর।''
এর পরের বর্ণনা নাচের-- '' মণ্ডপের অন্যদিকে বড় একটি হলঘরে সুন্দরী সব পশ্চিমা বাইজীদের নাচগান হচ্ছিল এবং ইয়োরোপীয় ও এদেশি ভদ্রলোকেরা সোফায় হেলান দিয়ে, চেয়ারে বসে সুরা-সহযোগে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। বাইরেও বহু সাধারণ লোকের ভিড় হয়েছিল বাইজীদের গান শোনার জন্য। গানের হিন্দুস্থানী সুরমণ্ডপে সমাগত লোকজনদের মাতিয়ে তুলেছিল আনন্দে।''
পুজোর কথায় তিনি লেখেন-- ''আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি চলতে থাকে। পাঁচদিন পরে ষষ্ঠির দিন দেবী জেগে ওঠেন এবং সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর দিনে মহাসমারোহে তাঁর পূজা হয়। নবমীর দিন বলিদান হয় এবং এককোপে মুণ্ডচ্ছেদ করতে না পারলে বলি নাকি সার্থক হয় না।'' সবশেষে তিনি লেখেন-- '' আর ধনিক বাঙালীবাবুরা পূজার সময় যে পরিমাণ অর্থব্যয় করেন তার হিসেব নেই।'' (অনুবাদ)
একটা 'ছোট্ট' খরচের কথাই ধরা যাক! সেকালের বিখ্যাত বাইজির নাম ছিল 'নিকি'। অল্প বয়সী। এটা সেই সময়ের কথা যখন ৪-৫ টাকা আয়ে একটি একান্নবর্তী সংসার চলে যেত। সেই সময়ে এক বাবু নিকিকে হাজার টাকা মাস খরচা দিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন। ১৮১৯ সালের ১৬ অক্টোবর 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল-- '' শহর কলিকাতায় নিকী নামে এক প্রধান নর্ত্তকী ছিল। কোন ভাগ্যবান লোক তাহার গান শুনিয়া ও নৃত্য দেখিয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া এক হাজার টাকা মাসে বেতন দিয়া তাহাকে চাকর রাখিয়াছেন।''
১৮২৩ সনে 'নেক্কী'কে (নিকি) পুজো বাড়িতে নাচতে দেখা যায়। নাচ-গান, খানাপিনা নিয়ে পূজামণ্ডপে মাতলামি, গণ্ডগোল যে হত না, তা নয়! ১৮১৮ সালের ১৭ অক্টোবর 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকা 'দুর্গোৎসব' শিরোনামে লিখল--- '' গত সপ্তাহে এই উৎসব হইয়াছে। কলিকাতার অনেক ভাগ্যবান লোক বিস্তর টাকা ব্যয় করিয়া যথেষ্ট আমোদ করিয়াছে। কিন্তু আমরা শুনিতেছি যে এক ঘরে কোন ইংলন্ডীয় লোক বড় মগড়া উৎপন্ন করিয়াছিল তাহাতে কলিকাতার ইঙ্গরাজি সমাচার পত্রে তাহারদিগকে অনেক লজ্জা দেওয়া হয়েছে।"
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Puja-feature-2020