১৮৯ বছরে প্রথমবার! উত্তম কুমারের স্মৃতিধন্য গিরিশ ভবনে মূর্তি নয়, পুজো হবে ঘটে
- Published by:Simli Raha
- news18 bangla
Last Updated:
এ বাড়ির ইতিহাস বহু পুরনো । এই বাড়ির পুজোর সঙ্গে নাম জড়িয়ে রয়েছে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের । আবার মহানায়ক উত্তম কুমারও এ বাড়ির পুজোর সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে ।
#কলকাতা: দক্ষিণ কলকাতার সুউচ্চ কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ পথ হারিয়ে দেয় এই বাড়ি ৷ চারপাশের আকাশছোঁয়া ইমারতকে হেলায় দিকশূন্যপুরে পাঠিয়ে দেয় ৷ মনে হয় মরুভূমির মধ্যেকার একটা মরীচিকা যেন ৷ সাদা ধবধবে, বিস্তৃত ঠাকুরদালানটা এখন আগমণী গান গাইছে ৷ দালানের দু’পাশে এ জানলা-ও জানলা দিয়ে কথা চালাচালি হচ্ছে চুটিয়ে ৷ যৌথ পরিবারের সবাই ভুলে গিয়েছেন কে কার আপন ভাই, আর কার আপন বোন ৷ এখন শুধু পুজোর সাজ, প্রতিমার রং, কেনাকাটা, সেলফির গল্প কলকলিয়ে উঠছে ১৮৯ বছরের পুরনো প্রাচীন বনেদিয়ানায় ভরপুর এই পুজোটাকে ঘিরে ৷
প্রতিবার মায়ের আগমণের আগের চিত্রটা এমনই থাকে । কিন্তু এ বার মন খারাপ নিয়ে বসে আছে ভবানীপুরের গিরিশ ভবন । করোনা নখ-দাঁত বের করেছে । তাই নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে গিরিশ ভনের যৌথ পরিবার । এ বছর আর খড়-বিচালি থেকে, এক মেটে-দো মেটে, রঙের মাধুর্যে সেজে উঠছেন না মা । এ বার শুধুই ঘটে পুজো হবে গিরিশ ভবনে । বিশ্বাস করা হয়, মায়ের প্রাণ অধিষ্ঠান করে মঙ্গল ঘটে । তাই এ বারের পুজোও হবে ঘটেই । যেখানে সকাল বিকাল পাত পড়ত কয়েকশ লোকের, এ বার সেখানে বিনা অতিথির পুজো । থাকবেন শুধুমাত্র বাড়ির সদস্যরাই । মন খারাপ সকলেরই । কিন্তু উপায় নেই যে ।
advertisement

advertisement
প্রতি বছর উল্টো রথের দিন ঠাকুর দালানে কাঠামোতে শুরু হয় ঠাকুর তৈরির কাজ । এ বছর আসতেই পারেননি প্রতিমা শিল্পীরা । বংশপরম্পরায় একই শিল্পী, একই ঢাকির পরিবার যুক্ত রয়েছে এই বাড়ির সঙ্গে । তাঁরা সকলেই ধামুয়া গ্রামের বাসিন্দা। কিন্তু এ বছর লকডাউনের কারণে আসতে পারছেন না তাঁরাও । এ বছর তাই আগমণীর সুর ঠিক তেমন করে বাজছে না নাটমন্দিরের চাতালে । ভারাক্রান্ত হৃদয়েই চলছে স্মৃতিচারণা ।
advertisement
এ বাড়ির ইতিহাস বহু পুরনো । এই বাড়ির পুজোর সঙ্গে নাম জড়িয়ে রয়েছে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের । আবার মহানায়ক উত্তম কুমারও এ বাড়ির পুজোর সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে । উত্তম কুমারের বাড়ির পাশেই এই বিখ্যাত গিরিশ ভবন । প্রতি বছর এই বাড়ির পুজোর সময়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হাজির থাকতেন উত্তম কুমার । জগদ্ধাত্রী পুজোয় বিখ্যাত ছিল গিরিশ ভবনের নাটক । বাড়ির সদস্যরা মিলেই লেখা হত, গান-নাচ হত, অভিনয় করা হত । আর সেই নাটকেই প্রতি বছর অভিনয় করতেন মহানায়ক। এই বাড়ির পুজোর ইতিহাসটা একটু উল্টে দেখে নেওয়া যাক ।
advertisement

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে (দক্ষিণ) ২৪ পরগনার ধামুয়া থেকে রাঢ়ি শ্রেণির ব্রাহ্মণ হরচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁর ছিল পৌরোহিত্যের পেশা। পরিবারসূত্রে জানা যায়, তিনি অর্থ সঞ্চয় করে ভবানীপুরের চক্রবেড়িয়া অঞ্চলে ঠাকুরদালান-সহ ভদ্রাসন নির্মাণ করে ১৮৩২ থেকে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। বাড়ির বর্তমান ঠিকানা ৩৯ গিরিশ মুখার্জি রোড। পুত্র গিরিশচন্দ্র ছিলেন সে যুগের নামকরা উকিল।
advertisement

আবার স্বনামধন্য সংস্কৃত পণ্ডিত-ও বটে ৷ তাঁর আমল থেকে পুজোর জৌলুস বৃদ্ধি পায়। আগে পুজো হত মাটির আটচালায় ৷ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছ থেকে জলপানির টাকা পেয়ে এই ঠাকুরদালানটি তৈরি করিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র ৷ একচালার মহিষমর্দিনী মূর্তি ১৮৬ বছর ধরে একই কাঠামোতে পুজো হয়ে আসছে ৷ তবে সিংহ এখানে আধুনিক রূপে ৷ আগে প্রতিপদ থেকেই ঘট বসত পুজোর ৷ তবে এখন পঞ্চমী থেকে বসে ৷ এ বাড়ির পুজোর সংকল্প হয় বাড়ির পুত্রবধূদের নামে ৷ যাঁর নামে সংকল্প হয় তিনি পঞ্চমীর দিন শুধু ঠাকুরের অন্নভোগ আর রাতে ফলমূল আহার করেন ৷ আর ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত তিনি শুধুমাত্র রাতে আরতির পর প্রসাদ খান ৷ এ বাড়ির কুলদেবতা অষ্টধাতুর জগদ্ধাত্রী মাতা ৷ এ বাড়ির মেয়ে-বৌরা জগদ্ধাত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত হন ৷ দীক্ষিত হলে তবেই তিনি বাড়ির ভোগ রাঁধতে পারেন ৷
advertisement

আগে একচালার প্রতিমায় সাবেকি ডাকের সাজ হত ৷ এখন অবশ্য মা’কে বেনারসী শাড়ি পরানো হয় ৷ শুধু দুর্গা নন, সকলেই পরেন শাড়ি আর কার্তিক-গণেশ পরেন ধুতি ৷ বাড়ির সমস্ত সদস্যরা একজোট হয়ে মা’কে সাজান নিজের হাতে ৷ ভাসানের পর সেই বেনারসী নিয়ে এসে কোনও গরীব-দুঃখীকে দান করা হয় ৷ এখানে নবপত্রিকাকে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে স্নান করানো হয় না ৷ বাড়িতেই হয় স্নান ৷ তারপর বাড়ির সদস্যরা কলা বৌ’কে বরণ করে ঠাকুরদালানে তোলেন ৷ বাড়িতে রয়েছে প্রতিষ্ঠা করা বেল গাছ ৷ সেখানেই ষষ্ঠীর দিন প্রথমে শুরু হয় পুজো ৷ তারপর মা’কে সিঁদুর পরিয়ে, বরণ করে শুরু হয় পুজো ৷
advertisement

অষ্টমীর দিন ১৬ কেজি চালের আর সেরা ফল দিয়ে নৈবেদ্য সাজানো হয় ৷ বাড়ির পুরুষ মানুষরাই এই কাজটা করে থাকেন ৷ আর এখানে দশমীর দিন সকালে রয়েছে আরও একটি অভিনব আচার ৷ ওই দিন মায়ের প্রাণ বিসর্জনের আগে পৈতেধারী ব্রাহ্মণরা দুর্গাস্তোত্র উচ্চারণ করতে করতে দেবীকে প্রদক্ষিণ করেন ৷ আর দশমীর দিন সন্ধেবেলা বিসর্জনের আগে বাড়ির এয়োস্ত্রীরা তাঁদের সবচেয়ে ভাল শাড়ি আর প্রচুর গয়না পরে মা’কে বরণ করেন ৷
বাড়ির ঠাকুর এখনও কাঁধে করে বিসর্জনে যান ৷ নিরঞ্জনের পরে কাঠামো থেকে মূর্তিকে আলাদা করে আবার সেটি তুলে নিয়ে আসা হয় ৷ পরের বছরের অপেক্ষায় আবারও শুরু হয় দিন গোনা ৷
তবে এ বছরের চিত্রটা প্রথম থেকেই অন্যরকম । মা আসেননি মৃণ্ময়ী রূপে । এ বার মঙ্গল ঘটেই অধিষ্ঠান করবেন তিনি । বাড়ির সকলে একটাই প্রার্থনা জানাবেন দেবীর কাছে, এই দুঃসময় কেটে যাক, পরের বছর যেন তোমায় ঘটে করে ঘরে আনতে পারি ।
ছবি : গিরিশ ভবনের সৌজন্যে
Location :
First Published :
October 10, 2020 3:29 PM IST