বাঙালিকে প্রথম ছানা চিনিয়েছিল পর্তুগিজরা, বাকিটা রসাল-ইতিহাস...
- Published by:Arindam Gupta
- news18 bangla
Last Updated:
আধুনিক রসগোল্লা ও সন্দেশের বয়স কিন্তু মাত্র দুশো থেকে আড়াইশো বছর৷ এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল ছানার আবির্ভাব কিন্তু পর্তুগিজদের হাত ধরে৷
বাঙালি ও ছানা৷ শব্দদুটি শুনে অনেকেই হয়তো ভাবছেন ছানা অর্থাৎ ছোট শিশুকে নিয়ে হয়তো কিছু বলা হচ্ছে৷ কিন্তু তা ঠিক নয়৷ আজ ফিরে দেখা যাক বাঙালির পাতে কী ভাবে ছানা এবং ছানা জাত মিষ্টি আসন গ্রহণ করল৷ আধুনিক রসগোল্লা ও সন্দেশের বয়স কিন্তু মাত্র দুশো থেকে আড়াইশো বছর৷ এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল ছানার আবির্ভাব কিন্তু পর্তুগিজদের হাত ধরে৷ ষোড়শ শতকে পর্তুগিজরা ভারতে প্রথমবার পা ফেলল এবং তাদের সঙ্গেই ছানা চলে এল ৷
পশ্চিমবঙ্গের ব্যান্ডেল অঞ্চলে তারা তাদের ঘাঁটি গড়ে তোলার পর শুরু হল ছানার যাত্রা৷ পর্তুগিজরা মূলত ৩ রকম চিজ তৈরি করত৷ তার মধ্যে "কটেজ চিজ" ছিল ছানার আদি প্রকার৷ এছাড়াও "ব্যান্ডেল চিজ" যা বার্মার (বর্তমানে মায়ানমার) রাঁধুনিদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল পর্তুগিজদের তত্ত্বাবধানে এবং "ঢাকাই পনির"৷ ব্যান্ডেল চিজ কিন্তু আজও সমান জনপ্রিয় এবং কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন নিউ মার্কেট অঞ্চলেও পাওয়া যায়৷ উপমহাদেশে ছানা তৈরির শিক্ষাবিস্তার অনেক পরের ঘটনা৷ এমনকী প্রথম দিকে ছানা ও ছানার মিষ্টি একরকম পরিত্যাজ্যই ছিল ধর্মীয় কারণে।
advertisement

advertisement
বৈদিক যুগে দুধ ও দুধ থেকে তৈরি ঘি, দধি, মাখন ইত্যাদি ছিল দেবখাদ্য৷ বিশেষ করে ননি ও মাখন অত্যন্ত প্রিয় ছিল শ্রীকৃষ্ণের৷ সেই জন্য তাঁকে মাখনচোর বলেও সম্বোধন করা হয়। ঠিক এই কারণে দুধ থেকে রূপান্তরিত ওই সব খাদ্য শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হতো৷ কিন্তু ছানা তৈরি হয় দুধ বিকৃত করে এবং ছানা কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো ছিন্ন করা৷ এ জন্য মনুর বিধানমতে, ছানা ছিল অখাদ্য।
advertisement
মহারাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্নের এক রত্ন অমর সিংহ রচিত ‘অমরকোষ’-এ (ব্রহ্মবর্গ: ২/৫৬) বলা হয়েছে, ‘উষ্ণ দুধে দধি যোগ করলে তাকে ‘আমিক্ষা’ বলে৷ তখন আরও দুটি নাম ছিল। গরম দুধে দই দিলে দুধটা কেটে যে সাদা অংশ তৈরি হয় তার নাম ‘দধিকুর্চিকা’৷ এবং নষ্ট দুধ অপবিত্র, নষ্ট হওয়া জিনিস খেতে নেই বা ভগবানকেও দিতে নেই৷ তাই তা ছিল মানুষের জীবন থেকে দূরে। ছানা নামকরণ নিয়ে আর একটি দেশীয় মত রয়েছে, গরম দুধে দধি সংযোগে যখন জল এবং সাদা সারাংশ আলাদা হয়ে যায়, তখন সাদা সুতির কাপড়ের হালকা টুকরোতে ‘ছেনে’ জল থেকে সাদা পিণ্ডাকার বস্তুটিকে জলহীন করে বলে এর নাম হয় ‘ছেনা’ বা ‘ছানা’।
advertisement
এ সম্পর্কে সুকুমার সেন তাঁর 'কলিকাতার কাহিনী' বইয়ে লিখেছেন, “ক্ষীর-মাখন-ঘি-দই—এগুলো কাঁচা দুধের স্বাভাবিক পরিণাম, কৃত্রিম অথবা স্বাভাবিক। কিন্তু কোনোটিই দুধের বিকৃতি নয়। ‘ছানা’ কিন্তু ফোটানো দুধের কৃত্রিম বিকৃতি। বাঙালি অন্য দ্রব্য সংযোগ করে দুধ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, যাতে সারবস্তু ও জলীয় অংশ পৃথক হয়ে যায়। এভাবে দুধ ছিন্নভিন্ন করা হয় বলেই এর নাম হয়েছিল বাংলায় ‘ছেনা’, এখন বলা হয় ‘ছানা’৷ সংস্কৃত ভাষায় ছানার কোনও রকম উল্লেখ নেই। অন্য ভাষাতেও ছিল না।
advertisement
আগে অজ্ঞাত ছিল বলেই শাস্ত্রসম্মত দেবপূজায় ছানা দেওয়ার বিধান নেই।”
সেই জন্য প্রাচীন যুগে ছানার বদলে মণ্ডা বা ক্ষীরের চাক ব্যবহার করা হত I এছাড়াও বাংলা সাহিত্যে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় খুঁজে পাওয়া যায় তৎকালীন যুগে গ্রামাঞ্চলে বিয়ে, উপনয়ন বা শ্রাদ্ধ ও যে কোনও অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ ভোজন আবশ্যিক ছিল এবং মিষ্টির মধ্যে ক্ষীর ও কদম জাতীয় মিষ্টির প্রাদুর্ভাব বেশি মাত্রায় ছিল৷ প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল তার "রূপমঞ্জরী" উপন্যাসে ছানার মিষ্টির প্রচলনের কথা উল্লেখ করেছিলেন I
advertisement
শেষে বলতে হয়, ছানা এখন আর ছানা নেই সে হয়েছে সাবালক I
প্রতিবেদনে ঋত্বিক ঘোষ
view commentsLocation :
First Published :
August 24, 2020 5:17 PM IST