#নয়াদিল্লি: করোনার করাল গ্রাসে মা-বাবাকে হারিয়ে অনাথ হয়ে গিয়েছে অসংখ্য শিশু। তাদের জন্যই ‘পিএম কেয়ার ফর চিলড্রেন স্কিম’-এর ( PM CARES for Children) অধীনে নতুন স্কলারশিপ এবং স্বাস্থ্য বিমা নিয়ে এল মোদি সরকার। অসহায় অনাথ শিশুদের ভবিষ্যতের জন্যই এই স্কিমের ঘোষণা করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশে করোনায় অনাথ শিশুর সংখ্যা কত? চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ল্যানসেটের (Lancet) একটি সমীক্ষায় দাবি করা হয়, ভারতে করোনা সংক্রমণের প্রথম ২০ মাসের মধ্যে ১৯ লাখ শিশু নিজের বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছেন। সেই সময় এই পরিসংখ্যানকে ‘অত্যাধুনিক চালাকি’ বলে কটাক্ষ করেছিল মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক। তাদের দাবি ছিল, করোনায় মা-বাবাকে হারিয়ে অনাথ শিশুর সংখ্যা মেরে-কেটে ১.৫৩ লাখের কাছাকাছি।
কোভিডে মা-বাবাকে হারিয়েছে এমন শিশুদের জন্য ‘পিএম কেয়ার ফর চিলড্রেন স্কিম’ কী? ২০২১ সালের ২৯ মে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narandra Modi) ঘোষণা করেন যে সমস্ত শিশুরা করোনা অতিমারীর কারণে তাদের বাবা ও মা, দুজনকেই হারিয়েছে, তাদের সাহায্য করবে কেন্দ্র। এই স্কিমের উদ্দেশ্য হল করোনা অতিমারীতে বাবা-মাকে হারিয়েছে এমন শিশুদের সঠিক পদ্ধতিতে সর্বাধিক যত্ন এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য বিমার মাধ্যমে তাদের সুস্থতার খেয়াল রাখা, শিক্ষার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতাশালী করে তোলা এবং তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাপনের জন্য তৈরি করা। এই সমস্ত শিশুর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য, সেকারণেই ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত এই আর্থিক সহায়তা তারা পাবে।
কোন বয়সে কত টাকা পাওয়া যাবে? পিএমও-র তরফ থেকে বিবৃতি জারি করে জানানো হয়েছে, কোভিডের জেরে যে সব শিশুর বাবা-মা দু’জনেরই মৃত্যু হয়েছে, তাদের বয়স ১৮ হলেই পরের পাঁচ বছর পর্যন্ত তারা ৪০০০ টাকা করে মাসিক ভাতা পাবে। স্কুলে থাকাকালীন ২০,০০০ টাকা বৃত্তি এই পিএম কেয়ারস থেকে পাবে। বয়স ২৩ হলেই তাদের ১০ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। আরও জানানো হয়, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তারা পাঁচ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্য বিমার সুবিধা পাবে কেন্দ্রের আয়ুষ্মাণ ভারত প্রকল্পের আওতায়। বিমার প্রিমিয়ামের টাকাও দেবে কেন্দ্র। তাদের লেখাপড়ার খরচের টাকাও দেবে সরকার। উচ্চশিক্ষার জন্য তারা ঋণ নিতে চাইলে, তাও দেওয়া হবে। সেই ঋণের সুদ-অর্থও পিএম কেয়ার্স তহবিল থেকে দেওয়া হবে।
আর কী সুবিধা দিচ্ছে এই প্রকল্প? শুধু তাই নয়, আয়ুষ্মান ভারত কার্ডের মাধ্যমে করোনায় অনাথ শিশুদের স্বাস্থ্য বিমা দেওয়া হবে। এই কার্ডের আওতায় ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনামূল্যে পরিষেবা পাবে তারা। যে কোনও মানসিক সাহায্যের জন্য সমবাদ হেল্পলাইনের মাধ্যমে কাউন্সেলিং দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বয়সী শিশুদের যত্নে বিভিন্ন নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে, ৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা পরিপূরক পুষ্টি এবং প্রাক-স্কুল শিক্ষার জন্য অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে সাহায্য পাবে। ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের বাড়ির কাছের যে কোনও সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল বা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় অথবা বেসরকারি স্কুলে একজন ডে স্কলার হিসাবে ভর্তি করা হবে। বেসরকারি স্কুলে টিউশন ফি ছাড় দেওয়া হবে। এই স্কিমে সমস্ত সরকারি প্রকল্পের সুবিধাও পাওয়া যাবে। যেমন সমগ্র শিক্ষা অভিযানের আওতায় বিনামূল্যে ইউনিফর্ম এবং দু’সেট পাঠ্যপুস্তক প্রদান করা হবে। এই স্কিমটি অনাথ শিশুদের হয় আত্মীয়স্বজন এবং পরিবারের যত্নে বা চাইল্ড কেয়ার ইনস্টিটিউশন (সিসিআই) বা সৈনিক স্কুল, নবোদয় বিদ্যালয় বা অন্যান্য আবাসিক বিদ্যালয়ে রাখতে সহায়তা করবে।
প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী? এই স্কিমের আওতায় নাম তোলার জন্য প্রাথমিক ভাবে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২-এর মধ্যে প্রয়োজনীয় সমস্ত নথিপত্র অনলাইন পোর্টাল pmcaresforchildren.in –এর মাধ্যমে জমা দিতে হবে। শিশু কল্যাণ কমিটিগুলিকে (জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্টের অধীনে রাজ্য সরকারগুলি দ্বারা গঠিত) প্রতিটি ঘটনার তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ সেগুলি পাঠাতে হবে জেলাশাসকের কাছে। ডিএম তারপরে সেই আবেদন খুঁটিয়ে দেখে তা গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করবেন। আবেদন গৃহীত হলে প্রাসঙ্গিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হবে।
২০২১ সালের জুলাই মাসেই যে সব শিশুরা করোনায় বাবা কিংবা মা অথবা বাবা মা দু’জনকেই হারিয়েছে, তাদের তথ্য দ্রুত পোর্টালে নথিভুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট দফতরের আধিকারিকদের নির্দেশ দেয় কেন্দ্র। নথিভুক্ত শিশুদের যাতে কোনও সমস্যা না হয় সে দিকে নজর রাখবে কমিশন। জানানো হয়েছে, এই স্কিমের অধীনে যাবতীয় সুযোগসুবিধা পাওয়ার জন্য আধার কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক। যদি কোনও অনাথ শিশুর আধার কার্ড না থাকে তাহলে অবিলম্বে জেলাশাসক তাকে আধার কার্ড করিয়ে দেবেন বলেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে ডিম বা জেলাশাসক সুবিধাভোগী যাচাইয়ের দায়িত্বে থাকছেন। পরবর্তীকালে তিনিই অভিভাবক হিসাবে কাজ করবেন। দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় বাকি করবে মহিলা ও শিশু উন্নয়ন বিভাগ বা রাজ্য/ইউটি-এর সামাজিক বিচার বিভাগ।
কার নেতৃত্বে থাকবে শিশুরা? করোনায় অনাথ শিশুদের কে দেখবে? কী তাদের ভবিষ্যৎ? এই নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে বিরোধীরা। আদালতে মামলাও হয়। সেখানেই অনাথ শিশুদের জন্য সরকারের ভাবনা এবং কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলে আদালত। কোভিডকালে অনাথ শিশুদের দেখভাল নিয়ে সরকারকে নির্দেশও দেয় সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত বলে, ‘অবিলম্বে অনাথ শিশুদের সাহায্যের ব্যবস্থা করুন। অভিভাবকহীন হয়ে অনেকেই হয় তো রাস্তায় অভুক্ত রয়েছে। কোর্টের পরবর্তী অর্ডার শোনার জন্য অপেক্ষা না করে কাজ করুন’।
পরে ২০২২ সালের মে মাসে, দিল্লি হাই কোর্ট কেন্দ্রকে একটি হলফনামা দাখিল করার নির্দেশ দেয় যাতে শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য নেওয়া পদক্ষেপগুলি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। কোভিড ১৯-এ তাদের পিতা-মাতাকে হারানো দ্বিতীয় শ্রেণি এবং পঞ্চম শ্রেণির দুই নাবালক একটি পিটিশন দায়ের করেছিল। সেই মামলাতেই এই আদেশ দিয়েছিল আদালত। এরপর ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ড রাইটস (এনসিপিসিআর)-এর তত্ত্বাবধানে জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্টের অধীনে শীর্ষ আদালত একটি পোর্টাল তৈরি করতে বলে। এরপরই তৈরি হয় ‘বাল স্বরাজ’। সেখানে করোনা কালে অনাথ শিশুদের ডেটা আপলোড করা হয়েছে। এনসিপিসিআর বলেছে যে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে পিতামাতাকে হারিয়েছে এমন সমস্ত শিশুদের ট্র্যাক করা হয়েছে। এবং সমস্ত রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে ‘বাল স্বরাজ’ পোর্টালে এই জাতীয় সমস্ত শিশুদের ডেটা আপলোড করার কাজ করা হয়েছে।
করোনা কালে ভারতের অনাথ শিশুদের নিয়ে বিতর্ক কেন?
২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রায় ১৯ লক্ষের বেশি শিশু কোভিডের কারণে তাদের একজন করে কাছের মানুষ, অভিভাবককে হারিয়েছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি সমীক্ষায় এমনই দাবি করে ল্যানসেট। শোরগোল পড়ে যায় দেশ জুড়ে। পাল্টা প্রেস বিবৃতি দিয়ে কেন্দ্র সরকার বলে, ‘এই সংখ্যা সত্য এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। নাগরিকদের মনে আতঙ্ক তৈরির উদ্দেশ্যে এক অত্যাধুনিক চালাকি’। এনসিপিসিআর জানায়, কতজন অনাথ হয়েছে সেই সংখ্যা তারা ‘নিরবিচ্ছিন্নভাবে ট্র্যাক’ করে চলেছে। সরকারের নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী, করোনার জেরে ভারতে ১.৫৩ লক্ষ শিশু অনাথ হয়েছে। তাদেরকেই সব রকম সাহায্য করার জন্য এই স্কিম।
আরও পড়ুন- মুম্বই-সহ পাঁচটি রাজ্যে লাফিয়ে বাড়ছে কোভিড সংক্রমণ! তবে কি এসে গেল চতুর্থ ঢেউ?আমেরিকা, ব্রাজিলের পর বিশ্বে সবথেকে বেশি কোভিডে মৃতের সংখ্যা ভারতে। দেশের সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে কোভিডে মৃতের এই ডেটা পেয়েছে সরকার। সূত্রের খবর, কোভিডে বাবা-মাকে হারিয়ে এখন এইসব অনাথ শিশুরা তাদের আত্মীয় বা পরিচিতদের কাছেই রয়েছে। রাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে এই অনাথ শিশুদের বিষয়ে সমস্ত খবর রাখছে কেন্দ্র।
কত আবেদন জমা পড়েছে? এখনও পর্যন্ত, পিএম কেয়ার ফর চিলড্রেন- স্কিমের অধীনে ৩৩টি রাজ্যে থেকে ৯,০৪২ টি আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৪,৩৪৫ টি আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে।। সবথেকে বেশি আবেদন পড়েছে মহারাষ্ট্র (৭৯০) থেকে। এর পরেই রয়েছে উত্তরপ্রদেশ (৪৪১), মধ্যপ্রদেশ (৪২৮), তামিলনাড়ু (৩৯৪), তেলঙ্গানা (২৫৬), অন্ধ্রপ্রদেশ (৩৫১), গুজরাত (২২৩), কর্নাটক (২২১) ও রাজস্থান থেকে এসেছে ২০৬টি আবেদন। এর মধ্যে সব থেকে বেশি অনুমোদন পেয়েছে মহারাষ্ট্র (৭৯০), উত্তরদেশ (৪৪১), এবং মধ্যপ্রদেশ (৪২৮)-এর আবেদন। প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে ২৯ মে এই প্রকল্প চালু হয়। অনাথ শিশুদের মানসিক কোনও সমস্যা হলে হেল্পলাইনের মাধ্যমেও তাদের সহায়তা দেওয়া হবে।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Corona