প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও কখনও নায়িকার রোলে কাজ পান না । কিন্তু আক্ষেপ থাকলেও বিরক্তি নেই । জমকালো ভিলেনের রোলে তিনি যেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী । বললেন, ভিলেন করতে তাঁর ভাল লাগে । তাঁর তৈরি ডায়লগ চরম জনপ্রিয় । মন খুললে প্রীতি বিশ্বাস যেন একেবারে ঘরের মেয়ে । একান্ত সাক্ষাৎকারে গল্প জমালেন সিমলি রাহার সঙ্গে ।
প্র: রাস্তায় বেরোলে কি লোকে গালমন্দ করে ?
উ: না, ঠিক ওরকম করে না । আজকাল দর্শকরা খুব স্মার্ট হয়ে গিয়েছেন । আগের মতো ব্যাপারটা নেই । তবে হ্যাঁ, কেউ যে কিছুই বলে না তা নয় । হয়তো কেউ কাছে এসে আলাপ করল, সেলফি তুলল । আবার না থাকতে পেরে কেউ কেউ বলেই ফেলেন, ‘এই তুমি এত বদমায়শি কেন করছো গো ? একটা মেয়ে’কে তুমি মেরেই ফেললে ?
প্র: বিয়ের দিনেও নাকি এ রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল ?
উ: হ্যাঁ গো, শ্বশুরমশাই’কে লোকে ডেকে বলেছে ন, কেমন বৌমা ঘরে আনলেন । যা ঝগড়ুটে । আবার হয়তো আমার শাশুড়ি মা, ননদ বিয়ের নেমন্তন্ন করতে গিয়েছেন । তখনও কেউ কেউ বলেছেন, তোমার বৌ’তো খুব ঝগড়ুটে । একজন’কে খুনও করেছে । আরে এটা তো বুঝতে হবে, ওটা অভিনয় । তাছাড়া সিরিয়ালে আমার বড়, বড় ছেলে-মেয়ে, বরও অনেক বড়...লোকে সেটাই বিশ্বাস করে নেয় । রাহুলকে এসে লোকে বলেছে, ‘শেষে জেঠিমা’কে বিয়ে করলি ?’
প্র: এতো জবরদস্ত ভিলেন কী করে হলে?
উ: সত্যি বলতে কী আন্নাকালী ভিলেন হলেও তার কোনও আলাদা সাজপোশাক, উগ্র মেকআপ নেই । সাধারণ গ্রামের বৌয়ের সাজেই সে ভিলেন । এ বার সেটা করাটা হয়তো একটু টাফ ছিল । নিজেকে ভিলেন রূপে প্রতিষ্ঠা করা... একটু সময় তো লাগেই । কিন্তু এটাই তো অভিনয়, এটা তো আমাকে করতেই হবে ।
প্র: আন্নাকালীর চরিত্রটার মধ্যে নিজের কতটা ইনপুট রয়েছে?
উ: কী বলতো, আমি সবসময় চেষ্টা করি আমার চরিত্রের মধ্যে কিছু একটা নিজস্ব ছাপ রাখতে । যখন ‘রমণীর গুণে’ করছিলাম, সাহানাদি সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিল । বলেছিল, কীভাবে এরকম ভাবে করতে পারলি । ওখানেও চরিত্রটা নিজের মতো করেই গড়েছিলাম । এগুলো সবই আমার নিজের ইনপুট । ‘সুহানী’তে যেমন ‘সৌরভ’ কথাটা । ওটাও নিজেই তৈরি করেছিলাম । গ্রামে শো করতে গেলেই সবাই অনুরোধ করত ‘সৌরভ’ বলে ডাকার জন্য । যেমন জাদুকরী’র চরিত্রে ‘তমশা’ কথাটা এমন করে বললাম যে সেটাই হিট করে গেল । আন্নাকালীও তেমন অনেকটাই নিজের মতো করে তৈরি ।
প্র: আর আন্নাকালীর জনপ্রিয় কথাটা কার তৈরী?
উ: ‘ও মা রে’ কথাটাও পুরোপুরি আমার নিজের তৈরি । পরিচালকের থেকে অনুমতি নিয়েই এই কথাটা আমার চরিত্রের মুখে আমি বসিয়েছিলাম । সেটাই তারপর তুমুল জনপ্রিয় হয়ে গেল।
প্র: আন্নাকালী’র মধ্যে কী X-Factor দেখলে ?
উ: আন্নাকালীর মধ্যে সত্যিই অনেক X-Factor রয়েছে । ওঁর এই যে মিষ্টি মিষ্টি কথার ছুরি, চালচলন...সবটা মিলিয়েই অন্যদের চেয়ে আলাদা আন্নাকালী ।
প্র: তোমাকে নায়িকার রোলে দেখতে পাই না কেন ?
উ: আমার প্রোফাইলে এসে অনেকেই এরকম বলেন, আগেও অনেক জায়গায় এ প্রশ্নটা করা হয়েছে । লোকে বলে, তোমার মধ্যে তো সবরকম গুণ রয়েছে, তাহলে তুমি নায়িকার চরিত্রে নেই কেন ? সত্যি কথা বলতে, এর উত্তরটা আমিও জানি না । এত বছর ধরে আমি কাজ করছি, কিন্তু সব সময় সেকেন্ড লিড বা পার্শ্ব চরিত্র । আমি তো অনেক ছবিও করেছি । মিঠুন দা’র সঙ্গে করেছি । ‘রং রুটে’ হিরোইন ছিলাম । সেখান থেকেই রাহুলের সঙ্গে আমার আলাপ । ভোজপুরী ছবিতেও আমার নিজস্ব একটা বড় জায়গা রয়েছে । সেখানেও আমি হিরোইন । কিন্তু সিরিয়ালে লিড পাই না বলে প্রথমে এটা নিয়ে খুব দুঃখ করতাম । তারপর দেখলাম সেটা যখন হওয়ার নয়, তখন আমার কাছে যে চরিত্র আসছে সেটাই মন-প্রাণ লাগিয়ে করব । আর একটা সিরিয়ালে হিরো-হিরোইন আর ভিলেনই প্রধান । তখন ভাবলাম তা হলে ভিলেনটাই আমি নিজের মতো করে করব ।
প্র: শুরুর গল্পটা একটু বলো? অনেক ছোটবেলা থেকে তো শুরু...
উ: আমি নাচ শিখতাম । সেখান থেকেই আমাদের পরিচিত এক কাকু আমাকে স্নেহাশিস চক্রবর্তীর কাছে নিয়ে আসেন । তারপর থেকে ছোটখাট কয়েকটা চরিত্র করেছিলাম । সেই হিসাবে প্রথম ব্রেক পাই ‘বেহুলা’তে । সেখানে চাঁদ সদাগরের বিধবা পুত্রবধূ হয়েছিলাম । তখন আমার ১৭-১৮ বছর বয়স । তারপর এটাই যে কখন পেশা আর নেশা হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না । একে একে অনেক কাজই করলাম এত বছরে ।
প্র: সৌদামিনীর সংসার একটু অন্য ধাঁচের সিরিয়াল। দর্শকরা কেমন ভাবে নিচ্ছেন?
উ: খুবই ভাল ভাবে নিচ্ছেন । দেড় বছর অতিক্রম করে ফেললাম আমরা । আসলে সৌদামিনীর নিজস্ব একটা জায়গা রয়েছে । গ্রামে যখন শো করতে গিয়েছি, এটা খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছি । দর্শকরা রাত ১১টা পর্যন্ত জেগে থাকেন সৌদামিনী দেখার জন্য । বাচ্চাদের কাছে তো সদু দিদি ভীষণ প্রিয় । আর আমি ততটাই অপ্রিয় (হাসি) ।
প্র: আন্নাকালী আর প্রীতির মধ্যে কতটা মিল?
উ: (হো হো হো) একদমই মিল নেই । একটুও না । ঝগড়া করতে আমি একটুও ভালবাসি না । প্রীতি’কে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন । কোথাও কারও এতটুকু উপকারে লাগলে সেটা করতে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি । কিন্তু কারও ক্ষতি আমি চাই না । তবে আমি অন্যায় দেখলে চুপ করে থাকতে পারি না । যেচে কারও উপকার করতে গিয়ে অনেক সময় গাড্ডায় পড়েছি। তবু শিক্ষা নেই আমার । তবে আমিও আন্নাকালী’র মতো ভীষণ টকেটিভ । এটুকুই মিল । আর আমি নিজেই চাই আন্নাকালী’র কঠিন শাস্তি হোক । (হাসি)
প্র: রাহুলের মধ্যে কী এমন দেখলে যা অন্য কারোর মধ্যে নেই?
উ: কিচ্ছু না । এই প্রশ্নটার গুরুত্ব আমার জীবনে নেই । শুধু একজন ভাল মানুষকে খুঁজে পেয়েছিলাম আমি রাহুলের মধ্যে । ওঁর মূল্যবোধ, ওঁর স্বভাব, ওঁর মেয়েদের প্রতি সম্মান, ডাউন টু আর্থ মানসিকতা... সবটা মিলিয়ে ওঁকে ভালবেসেছি । অনেকেই বলেছে, তুই এতদিন ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছিস, রাহুল তো নতুন । এসবে আমার কিছুই এসে যায় না । দেখতে সুন্দর, মাচো ফিগার, পয়সাওয়ালা..এসব দেখে ভালবাসা হয় না । ‘রং রুট’-এর সময় আমাদের পরিচয় হল। আউটডোরে গিয়ে বন্ধুত্বটা গাঢ় হল আরও । দু’জনেই ঠিক করলাম সেটেলড করব । কোনওদিন লুকোছাপা করিনি । আর আমাদের দুই বাড়ির মানুষরাও এত ভাল, যে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সিদ্ধান্ত তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন ।
প্র: নতুন বাড়ি কেমন? সংসার সামলে কাজ করতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না?
উ: আমি ব্লেসড । অনেক ভাগ্য করলে মানুষ এমন শ্বশুর-শাশুড়ি-স্বামী পায় । আমার মনেই হয় না বিয়ের পর আমার জীবনের কিছু পাল্টেছে । মা-বাবা তাঁদের মেয়ের মতো করে ভালবাসেন আমাকে । সংসারের কোনওদিকে খেয়াল রাখতে হয় না । কাজে বেরনোর সময় পারলে শাশুড়ি মা আমাকে মেখে খাইয়ে দেন । আর রাহুলের মতো সত্যিই ছেলে হয় না । ওঁর মধ্যে দায়িত্ববোধ এতটাই যে, ও যা যা আমাকে বলেছিল সব কথা রেখেছে । প্রথমেই বলেছিল, প্রেম করবো বিয়ে করার জন্যই । এক বছর প্রেম করেছি আমরা, ৩৬৫ দিনই রাহুল আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে নর্থ থেকে সাউথে । বলেছিল একটা প্রজেক্ট শেষ করেই বিযে করবে । ‘দেবী চৌধুরানি’ শেষ করার পরেই বিয়ে হল আমাদের । সত্যি, আমার দুই বাড়ির তুলনা হয় না ।
প্র: ট্রোল নিয়ে বিব্রত হলে কী ভাবে সামাল দাও সেটা ?
উ: ট্রোলটা খুব খারাপ ভাবে ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলে । সিরিয়ালে সৌদামিনী’কে মারার পর নোংরা ভাষায় আমাকে আক্রমণ করা হয়েছে । লোকে ‘খুনি’ তকমা দিয়ে দিচ্ছে । এমনকি এও লিখেছে, তোমার ছেলে-মেয়েকে এ ভাবে মরতে হবে । যাঁরা হয়তো সিরিয়ালটা দেখেন না, তাঁরা আমার প্রোফাইলে এসে দেখছেন এই সব লেখা । ভোজপুরী ইন্ডাস্ট্রিতে আমি খুব জনপ্রিয় । সেখানকার মানুষরা দেখলে তো সত্যিই আমাকে এইসব ভেবে নেবে । এসব দেখলে খুব রেগে যাই । তবে হেল্দি ট্রোল নিয়ে আমার কোনও আপত্তি নেই । হোক না । সেটাও তো পাবলিসিটি ।
প্র: ভোজপুরী’তে এত জনপ্রিয়তা এল কী করে ?
উ: ‘রং রুট’-এর সময় আমাদের ক্যামেরা অ্যাসিস্ট্যান্ট কিশোর দা আমাকে ভোজপুরী ছবি করার জন্য বলেন । এরপর আমি করলাম ‘রাজা রানি’ । ভীষণ হিট হয় সেই ছবি । আমাকে ১ মাস সময় দিয়ে বলেছিল ওয়েট পুট অন করতে হবে । ওই এক মাসে আমি এমন মোটা হলাম যে, পরিচালক আমাকে দেখে বলছেন এতটাও বলিনি (হাসি) । তারপর তো ওখানে পরপর পাঁচটা ছবি করলাম । ‘রাজা রানি’র পর দু’বছর গ্যাপ পড়ে যায় আমার । সে সময় ইউটিউবে তো ভিডিও বেরিয়ে গেল, আমি মরে গিয়েছি । ভোজপুরী ছবি করে প্রচুর অ্যাওয়ার্ড পেলাম । কিন্তু তারপর ওখানের কাজে, পেমেন্টের ব্যাপারে এত সমস্যা হতে শুরু করল যে, আর কন্টিনিউ করলাম না । তবে এখনও কয়েকটা হাউজ আছে, ওঁরা এত ভাল যে আবার কাজ করতে ডাকলে আবার যাব । এখনও ডাকছে । কিন্তু এখন তো সিরিয়ালের কাজ নিয়ে নিয়েছি ।
প্র: আন্নাকালী কি অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে প্রীতিকে?
উ: সেটা তো অবশ্যই । আমার কাছে আমার সব চরিত্ররাই কিন্তু সমান ভালবাসার । তবে শুধুই ট্রোল নয়, আন্নাকালী করে দর্শকদের ভালবাসাও আমি কম পাইনি । সে দিক থেকে তো অবশ্যই আমি লাকি এরকম একটা চরিত্র পেয়েছি বলে ।