অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১০ দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝবার পর ৩৭ বছর আগে এক ২২ জুলাই যখন মহুয়া রায়চৌধুরী দূরের দেশে চলে গিয়েছিলেন তখন তাঁর কাঁধে ১৫ টি ছবির ভার৷ শুধু টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি নয়, তাঁর উপর ছিল নিজের সংসারকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ ভারও ৷ সুচিত্রা, সুপ্রিয়া, মাধবী, সন্ধ্যা পরবর্তী সময়ে যে মুখগুলি বাংলা ছবির নায়িকা হয়ে উঠতে পেরেছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতমা তিনি৷ তাঁর নামে মাদকতা থাকলেও চেহারা ও অভিনয়ে ছিল পাশের বাড়ির মেয়ের মিষ্টত্ব এবং লাবণ্যভরা আভিজাত্য৷ ছোটবেলা থেকেই নাচ ও গানে আগ্রহ ছিল৷ তখন অবশ্য তিনি মহুয়া নন, শিপ্রা৷ বিভিন্ন জলসায় অংশ নিতেন ‘সোনালি’ নামে৷ মেয়েকে তালিম দিয়ে তৈরি করেছিলেন মহুয়ার বাবা নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী৷ তিনি নিজেও ছিলেন নৃ্ত্যশিল্পী৷ ছায়াছবির দুনিয়ায় নিজের কিছু করতে না পারার ব্যর্থতা মেয়ের মধ্যে দিয়ে পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন নীলাঞ্জন৷ বুঝেছিলেন ছায়াছবিতে মেয়ের আগামী দিন উজ্জ্বল ৷
ঔজ্বল্য দরকার ছিল দমদমের ছাপোষা সংসারেও৷ অনেকটা সে জন্যই ‘সোনালি’ হয়ে জলসায় অংশ নেওয়া৷ পাড়ার জলসা থেকে ছবিতে উত্তরণ হয়েছিল তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালকের হাত ধরে৷ টালিগঞ্জে তরুণ মজুমদারের ‘আবিষ্কার’ হিসেবে পরিচিত হওয়ার সুবাদে ভিত প্রস্তুত হয়েছিল গোড়াতেই৷ শোনা যায়, সুচিত্রা সেনের রূপটানশিল্পীর কাছে খবর পেয়েছিলেন মহুয়ার বাবা নীলাঞ্জন৷ শুনেছিলেন পরবর্তী ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছেন তরুণ মজুমদার৷ নিয়ে গিয়েছিলেন মেয়েকে৷ প্রথম দর্শনেই পরিচালক ঠিক করে নেন এই কিশোরীই হবে তাঁর ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর অমলাবালা ৷ নায়ক নায়িকাদের নাম নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন তরুণ মজুমদার৷ তত দিনে তাঁর হাতে ইন্দিরা হয়েছেন মৌসুমী৷ এ বার শিপ্রাকে করলেন মহুয়া৷
আরও পড়ুন : দু’জনের দেখা তরুণ মজুমদারের স্মরণসভায়, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর সঙ্গে নিজস্বী পোস্ট ভাস্বরের
১৯৭৩ সালের ছবি ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ঝড় তুলেছিল বক্স অফিসে৷ ‘নয়া মিছিল’ ছবির জন্য খারিজ হওয়া কিশোরীই এ ছবিতে অমলাবালা হয়ে বাংলা ছবির আঙিনায় চিরকালের জন্য আসন পেতে বসলেন৷ একদলা মাটিকে যেমন গড়েপিটে আকার দেন কুমোর, ঠিক তেমনই শিপ্রাকে তৈরি করেছিলেন সন্ধ্যা রায়৷ সঙ্গে ছিল মাধবী মুখোপাধ্যায়ের অগাধ ভালবাসা আর প্রশ্রয়৷ তিনি ছিলেন মহুয়ার ‘মাধুমা’৷ তরুণ মজুমদার যদি তাঁর অভিনয়ের শিক্ষাগুরু হন, তাহলে যাপন প্রশিক্ষণের খুঁটি বেঁধেছিলেন অগ্রজা সন্ধ্যা ও মাধবীর কাছেই৷
যখন সবে ডানা মেলতে শুরু করেছে মহুয়ার ছবিজীবন, তখনই বিয়ে করে নিলেন প্রেমিক তিলক চক্রবর্তীকে৷ তাঁদের কৈশোরের প্রেম পরিণয়ে রূপান্তরিত হয় কৈশোরেই৷ ১৯৭৬ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে পরিবারের অমতে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেন মহুয়া৷ বাংলা ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করা তিলক পরে চাকরি করতেন ব্যাঙ্কে, কিশোরকণ্ঠী হয়ে গান গাইতেন মঞ্চে৷ বিয়ের পরের বছর নিজের জন্মদিন ২৪ সেপ্টেম্বরেই মা হলেন মহুয়া৷ গোঁড়া ইস্টবেঙ্গল ভক্ত ফুটবলপাগল মহুয়া ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘গোলা’৷ ভাল নাম ‘তমাল’৷ তিলক ও মহুয়ার নাম মিলিয়ে৷
আরও পড়ুন : ললিত বোধহয় জানেনও না আসলে তাঁর প্রেয়সী সুস্মিতাকে সবথেকে বেশি ভালবাসেন ইনি
যাঁরা কাছে ছিলেন তাঁরা শুনেছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী মহুয়ার মুখে শুধু তাঁর ‘গোলা’-র কথা৷ ব্যক্তিগত জীবনে গোলার মা হয়েই টলিউড শাসন করেছিলেন মহুয়া ৷ উত্তমকুমার থেকে শুরু করে অনুপকুমার, দীপঙ্কর দে, সন্তু মুখোপাধ্যায়, শমিত ভঞ্জ, তাপস পাল, রঞ্জিত মল্লিক, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়-স্বমহিমায় সকলের সঙ্গে অভিনয় করেছেন মহুয়া৷ উপহার দিয়েছেন একের পর এক বক্স অফিস সফল ছবি৷ ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘আজ কাল পরশুর গল্প’ এবং ‘আদমি অউর অওরত’-এর মতো ছবিতে তিনি অবিস্মরণীয়৷ ‘দাদার কীর্তি’-র প্রখর ব্যক্তিত্বধারিণী সরস্বতী কিন্তু পর্দার বাইরে ছিলেন প্রাণবন্ত ও উচ্ছল৷ নিজের শিকড়, সংগ্রামের দিনগুলো ভুলতে পারেননি৷ যখনই শুনেছেন তাঁর পরিচিত জন অর্থকষ্টে পড়েছেন, তিনি অকাতরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ আর ভালবাসতেন পশুপ্রাণী৷
তারকা হয়েও মহুয়া ছিলেন মাটির খুব কাছাকাছি৷ তাঁর ফিল্মোগ্রাফি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে ‘বাঘ বন্দি খেলা’, ‘সেই চোখ’, ‘কবিতা’, ‘বেহুলা লখিন্দর’, ‘ঘটকালি’, ‘পাকা দেখা’, ‘প্রিয়তমা’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘শেষ বিচার’, ‘সুবর্ণগোলক’, ‘সাহেব’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘ফাদার’, ‘ইমনকল্যাণ’, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘লালগোলাপ’, ‘পারাবত প্রিয়া’, ‘শত্রু’-সহ আরও অসংখ্য দর্শকমন ছুঁয়ে যাওয়া ছবির কথা না বললে৷ একদিকে তাঁর নায়িকাজীবনে যেমন বর্ণময় হচ্ছিল, অন্যদিকে ততই যেন আঁধার ঘনাচ্ছিল ব্যক্তিগত পরিসরে৷ ঘনিষ্ঠ বৃত্ত টের পেয়েছিল স্বামী তিলকের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে পড়েছিল৷ তাঁদের সঙ্গে থাকতেন মহুয়ার বাবা নীলাঞ্জনও৷ তিনিই কার্যত ছিলেন মহুয়ার ম্যানেজার৷
মহুয়ার পারিবারিক জীবনে কী করে বাসা বেঁধেছিল ঘুণপোকা, সেই আলোচনার উপর পর্দা পড়ে গিয়েছে৷ ধুলো জমেছে তাঁর মৃত্যুহস্যের উপরও৷ টলিউডের অন্দরমহলে কান পাতলে আবছাভাবে শোনা যায় সুরাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন মহুয়া ৷ জীবনে এসেছিলেন একাধিক পুরুষও৷ ধীরে গ্রাস করছিল অবসাদ৷ ঝলসানো শরীরে মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্যের আগেও চেষ্টা করেছিলেন নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ৷ শেষ পর্যন্ত সত্যি যখন তাঁর জীবনে ‘শেষ’ নেমে এল, তাকে ঘিরে প্রশ্নচিহ্ন রয়েই গেল৷
১৯৮৫ সালের ১২ জুলাই গভীর রাতে বেহালায় মহুয়ার ফ্ল্যাটে ঘটেছিল সেই ভয়ঙ্কর ‘দুর্ঘটনা’৷ বাড়িতে পরিচারকরা থাকলেও কেন নিজে রান্নাঘরে ছেলের জন্য দুধ গরম করতে গিয়েছিলেন তিনি? এ প্রশ্ন জেগেছে অনেকের মনে৷ বাড়ির লোক বার বার বলেছেন স্টোভ ফেটে দুর্ঘটনার কথা৷ কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ যে স্টোভ উদ্ধার করেছে, তা ছিল অক্ষত ও কেরোসিনশূন্য৷ অথচ মহুয়ার শরীরে কেরোসিনের গন্ধ ছিল৷ আর ছিল শরীরে আঘাতের কালশিটে৷ তাঁর স্বামীর শরীরেও আঘাত ছিল সামান্য৷ শোনা যায়, সে রাতে তিলকের সঙ্গে তীব্র বিবাদ হয়েছিল নেশাতুর মহুয়ার৷ তাঁর মৃত্যুকালীন বয়ানে মহুয়া বলে গিয়েছেন অসাবধানতায় তাঁর গায়ে আগুন ধরে গিয়েছিল৷ তিনি কি ছেলের কথা ভেবে কাউকে আড়াল করেছিলেন? প্রিয়জনরা তুলেছিলেন সে প্রশ্নও৷
এ সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি৷ এখন আর এ সব প্রশ্ন বড় একটা ওঠে না৷ সম্প্রতি তরুণ মজুদারের প্রয়াণে আবার ফিরে এসেছে মহুয়ার স্মৃতি৷ মহুয়াকে নিজের মেয়ে বলতেন পরিচালক৷ তাঁর মৃত্যুতে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলেন তিনি ৷ বলেছিলেন, জীবনে মৃত্যু নিশ্চিত৷ কিন্তু মহুয়ার মতো মৃত্যু যেন কারওর জীবনে না আসে ৷ যে জুলাই কেড়ে নিয়েছে মহুয়াকে, সেই মাসেই চলে গেলেন তরুণ মজুমদার ৷ রয়ে গেল তাঁর পরিচালনায় মহুয়ার পানপাতার মতো মুখে আয়ত দু’ চোখের নীরব অথচ বাঙ্ময় অভিনয়৷ আর রয়েছে মহুয়ার দু’টি পুরস্কার৷ ‘দাদার কীর্তি’ ছবির জন্য পেয়েছিলেন ফিল্ম ফেয়ার (আঞ্চলিক)-এর সেরা নায়িকার সম্মান ৷ তপন সিনহার পরিচালনায় ‘আদমি অউর অওরত’-এর ছবিতে তাঁর অভিনয় পুরস্কৃত হয়েছিল দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে৷ তবে তখন তিনি অনেক দূরে, সব ধরাছোঁওয়ার বাইরে৷ পুরস্কারের আগে বসেছিল ‘মরণোত্তর’ বিশেষণ৷
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Mahua Roychowdhury, Tarun Majumdar