ভোরবেলা শহর যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, ঠিক তখন কাটোয়া শহরের কলেজপাড়ার একটি ছোট্ট বাড়ির রান্নাঘরে আলো জ্বলে ওঠে। সেখানে একজন নারী নিঃশব্দে রাঁধেন ভাত, ডাল, সবজি। উদ্দেশ্য, নিজের পরিবারের জন্য নয়, শহরের ব্যস্ত স্টেশনের এক কোণে বসে থাকা সেই মুখগুলোর জন্য, যাঁদের পেটে দু’বেলা খাবার জোটে না। এই মহিলার নাম কাজুলী বিশ্বাস। তিনি একজন সাধারণ গৃহবধূ। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের একান্ত অপরিচিত মুখ।
advertisement
স্বামী অমল বিশ্বাস কলকাতায় কাজ করেন, ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। সংসার চলে কাজুলীর টেলারিং- এর কাজেই। বাবা-মা, স্বামী, সন্তান…এই চেনা চার দেওয়ালের মধ্যে ছিল তাঁর জীবন। কিন্তু সেই জীবনের গণ্ডি একদিন নিজেই ভেঙে দেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর মনের মধ্যে এক ব্যথা কাজ করছিল, যত বারই স্টেশনের পাশে কোনও বৃদ্ধ, অনাহারী শিশু বা অসহায় মানুষের দিকে তাকিয়েছেন, মনটা কেঁপে উঠেছে। ভাবতেন, ‘যদি কিছু করতে পারতাম’। কিন্তু সাহস পাননি। তারপর একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন, আর নয় অপেক্ষা। আর সেই দিনটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
নিজের কানের সোনার দুল বিক্রি করলেন। সেটাই ছিল তাঁর প্রথম পুঁজি। ছোট্ট পুঁজি কিন্তু ইচ্ছে বিশাল, দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কাজুলী বিশ্বাস বলেন, “আমার ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। প্রথমে সাহস পায়নি। কিন্তু পরে নিজের সোনার দুল বিক্রি করে এই কাজ শুরু করি।”
আজ চার মাস পেরিয়ে গেছে। প্রতিদিন রাতে বাজার করেন, ভোরে রান্না। সব নিজে হাতে। তারপর দুই বড় ব্যাগে খাবার ভরে কাটোয়া স্টেশন থেকে সকাল ৮:৫০-এর ট্রেনে চেপে পৌঁছে যান বর্ধমান স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে যাঁরা দিন গুজরান করেন, যাঁদের কপালে অন্ন জোটে না, তাঁদের মুখে তুলে দেন নিজের হাতে বানানো খাবার। সন্ধ্যা ৬:৩০- এর ট্রেনে আবার ফেরেন কাটোয়ায়। এ এক নিঃশব্দ, একলা যুদ্ধ। না আছে কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, না আছে স্পন্সর। পরিবারের থেকেও এখনও পাননি বিশেষ সহায়তা। তবুও কেউ থামাতে পারেননি তাঁকে। কারণ, কাজুলীর কাছে এই কাজ শুধুমাত্র দয়া নয়, এটা তাঁর নৈতিক কর্তব্য। তিনি আরও বলেন, “পরিবারের তরফে আগেও কোনও সহযোগিতা পাইনি, এখনও পাইনা। তবে আমার প্রতিবেশীরা আমাকে প্রচণ্ড সাহায্য করেন।”
বনোয়ারীলাল চৌধুরী