পরিবারের সদস্যরা আগে এই দুর্গা পুজোতে যেভাবে আনন্দ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পুজো উপভোগ করত সেইসব আজ অতীত। পরিবারের বর্তমান সদস্যরা জানান অর্থ অভাবে বেশ কিছুটা হলেও কমেছে পুজোর জৌলুস। খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন আর হয়ে ওঠে না সেই আয়োজন। তবে প্রাচীন জমিদারি প্রথা মেনেই আজও পূজা হয় নন্দিবাড়ী দুর্গা দালানে। জমিদারি প্রথা না থাকলেও এখনো সেই ঐতিহ্যবাহী নাম রয়ে গেছে নন্দিবাড়ীর। গ্রামের মানুষ এই নন্দী বাড়ী নামেই চেনেন সবাই। তবে অন্যান্য সময়ে কেউ খোঁজ খবর না রাখলেও দুর্গা পুজোতে নন্দীর দালানে দুর্গা প্রতিমা দর্শন করতে একবারের জন্য হলেও আসেন গ্রামের বাসিন্দারা । পুজো ঘিরে চারদিন ধরে চলে বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠান । পাকা ইটের দেওয়াল চুন সুরকির গাঁথুনি উপরে ও কড়ি কাঠের পাটাতন। সেই প্রাচীন কালের তৈরি জমিদার বাড়ি । বেশিরভাগ অংশই প্রায় ভগ্নদশা ।কোন রকমে টিকে আছে এই দালান টুকু। একসময়ে দুর্গাপূজাতে এই নন্দীবাড়ির জমিদারের বংশধরেরা নিমন্ত্রণ করে গোটা গ্রামের ব্রাহ্মণ ভোজন ও নর নারায়ণ সেবা করতেন, এখন আর তা সম্ভব হয়নি ।
advertisement
পরিবারে সদস্য সংখ্যা বাড়লেও তা ছোট ছোট পরিবারে ভাগ হয়ে গেছে অনেকগুলি পরিবারে। পরিবারের অনেক সদস্যই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বা কলকাতায় কর্মসূত্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন । এছাড়াও কেউ আবার কর্মসূত্রে পাড়ি দিয়েছে বিদেশে । তারা আর সেইভাবে এই জমিদার বাড়িতে যোগাযোগ রাখেনা। বর্তমানে কয়েকজন সদস্য হাটবসন্তপুর গ্রামের নন্দী বাড়িতেই থাকেন তারাই এই পূজোটি কে বাঁচিয়ে রেখেছেন। পরিবারের সদস্য প্রশান্ত কুমার নন্দী জানান, আমার বয়স প্রায় ৮০ বছর বাপ ঠাকুরদার আমল থেকেই দেখে আসছি আমাদের পুজো । নন্দী বাড়িতে দেবী দুর্গার রূপ হর পার্বতী এখানে শিব ও দেবী দুর্গার দুটি করে হাত । সঙ্গে থাকেন কার্তিক, গণেশ ,লক্ষ্মী, সরস্বতী,কলা বউ, জয়া ও বিজয়া তবে কোনো অসুরের মূর্তি থেকে না ।
আরও পড়ুন: পুজোয় ভবঘুরেদের পরনে নতুন জামা, পুলিশের মানবিক ভূমিকাকে কুর্নিশ জনতার
সেই প্রাচীনকাল থেকেই একইভাবে এই হরপার্বতীর মূর্তি বংশ-পরম্পরা ধরে পূজিত হয়ে আসছে নন্দিবাড়ী দালানে । প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের বেশি পুরাতন এই পূজো। প্রতিপদে ঘট ওঠে পবিত্র হিন্দু শাস্ত্র মেনে পঞ্জিকা মতে । প্রাচীন প্রথা মেনেই দেবী দুর্গার আরাধনা হয় । কথিত আছে কোনো এক সময় এই দেবী দুর্গার পূজো শুরু হত আকাশে শঙ্খচিল উড়তে দেখে । তারপর পূজোপাঠ করতেন কোন ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত নয়, স্বয়ং ব্রক্ষ্মদৈত্য । পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে বেশকিছু এই দেবী দুর্গার। জানা গেছে এক সময় হঠাৎই এক দিন দেবীপূজার সমস্ত মূল্যবান বাসন পত্র চুরি হয়ে যায় চোরা কুঠির জানালা ভেঙে । কিন্তু হরপার্বতীর কৃপায় অবশেষে উদ্ধার হয় চুরি যাওয়া সমস্ত বাসনপত্র। তখন এই নন্দী বাড়ির দুর্গাপূজার নবমীর দিন ছাগ বলি প্রথা চালু ছিল কিন্তু একসময় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণে সে বছর ছাগ বলী করা সম্ভব হয়নি।তাই পুরোহিতের নিদান অনুযায়ী তখন থেকেই বলি বন্ধ হয়ে যায়। হর পার্বতী আরাধনার বিশেষত্ব হল আমাদের এই বংশের সুখ ,শান্তি বজায় রাখতে দেবী দুর্গার শান্ত মূর্তি হর পার্বতী অর্থাৎ শিব ও দুর্গা পূজিত হয়। সেই প্রাচীনকালের একটি বৈশিষ্ট্য হল দালানে একটি বৃহৎ আকৃতির শঙ্খ আছে । সেই শঙ্খ বাজানো হয় মহালয়ার দিন থেকে যা গ্রামের মানুষ শঙ্খের আওয়াজ শুনে বুঝে উঠেন নন্দীবাড়ির দুর্গা দালানে দেবীর আরাধনা শুরু হয়েছে। এই রীতিনীতি আজও আমরা আঁকড়ে ধরে আছি নিষ্ঠার সাথে ।
নন্দীবাড়ির আরো এক সদস্য তাপস নন্দী জানান তখন যেভাবে জাঁকজমক হতো এখন সেরকম কিছু হয় না। আগে বিভিন্ন রকম আলো ও ফুল দিয়ে সাজানো হতো গোটা দালান ,অনেক বাজনা বাজতো কিন্তু এখন আর সেসব হয়না । বাড়ির বাচ্চারাই এখন বাজনা বাজিয়ে আনন্দে মাতিয়ে তোলেন পরিবারের সদস্যদের। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে এখন অনেকটাই ভাটা পড়েছে পুজোর অনুষ্ঠানে। তবে যে কজন সদস্য বর্তমানে নন্দী বাড়িতে আছি আমরা সকলে মিলেই এই পুজোটা দেখভাল করে। কলকাতা থেকে পরিবারের কয়েকজন সদস্য আসেন । তবে সেদিন আর এদিন দুটোর মধ্যে পার্থক্য অনেকটাই। তবে বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা নন্দীবাড়ির দুর্গাপূজাকে আবারও সাজিয়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে।