কালীপুজোর রেশ এখনও কাটেনি। জামাই বাঁদনা, ভাইফোঁটা-সহ বিভিন্ন উৎসবে যখন জঙ্গলমহলের হিন্দু বাঙালি মশগুল তখনই রীতি মেনে আদিবাসী গ্রামগুলিতে শুরু হয়ে গেল গরুখুঁটা উৎসব। এই উৎসবে গরু মানুষের অসম লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমন ধান কাটার মরশুম শুরুর আগে যাচাই করে নেওয়া হয় ঘরের পোষ্য গরুগুলির শারিরীক ক্ষমতা।
advertisement
রাঢ় বঙ্গ তথা বাঁকুড়ার অন্যতম লোক উৎসব হল ‘গরুখুঁটা’। অন্যান্য আদিবাসী উৎসবের মতোই গরুখুঁটাও অত্যন্ত প্রাচীন এক উৎসব। বিশেষত জঙ্গলমহলে ভাইফোঁটার দিন থেকে নব উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনার উপর ভর করে মানুষজন মাতেন গরুখুঁটা উৎসবে। বাঁকুড়ার বদড়া, নবজীবনপুর-সহ রানীবাঁধ, রাইপুর, সারেঙ্গা ব্লকের মূলত আদিবাসী প্রধান গ্রামে প্রাচীন ধারাবাহিকতা মেনে ‘গরুখুঁটা’ উৎসবে সামিল হলেন গ্রামের আট থেকে আশি। প্রাচীন এই আদিবাসী উৎসব দেখতে হাজির হন বহু দর্শকও।
আরও পড়ুনঃ ভয়ানক শোষক পোকা শুষে নিচ্ছে ধান গাছের সব রস, কালনায় আমন চাষে চরম ক্ষতি, সরকারি সহায়তার আশায় কৃষকেরা
এই উৎসবে একটি সবল গরু নির্বাচন করা হয়। গরুটিকে স্নান করিয়ে গরুর শিং এবং পায়ের খুরে তেল মালিশ করা হয়। গরুর গায়ে রঙিন গোল গোল ছাপ দিয়ে, নতুন ওঠা ধানের শিষ দিয়ে তৈরি করা মালা-সহ বিভিন্ন অলংকার। সেগুলি পরিয়ে দেওয়া হয় গরুর শিংয়ে। এর পর চলে গরুটিকে দীর্ঘক্ষণ পুজো অর্চনা। তারপর গ্রামের এক প্রান্তের শক্ত খুঁটিতে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় গরুটিকে। তারপর অহিরা গান গেয়ে ধামসা মাদল শৃগা-সহ আদিবাসী বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে লোম যুক্ত পশুর চামড়া দুলিয়ে ওই গরুকে উত্তেজিত করে চলে ক্ষমতা প্রদর্শনের পালা। আর এভাবেই আনন্দোৎসব মেতে ওঠেন আদিবাসী সমাজের মানুষজন।
তবে এই দৃশ্য দেখলেই মনে পড়ে যায় দক্ষিণ ভারতের জাল্লিকাট্টু অথবা স্পেনের বুল ফাইটিংয়ের কথা। মনে হয় এ যেন এক গবাদি পশুদের উপর এক ধরনের অত্যাচার। তবে এটা ঠিক অত্যাচার নয়। এই সংস্কৃতির ইতিহাস জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে বহু বছর আগে। জানা যায়, বহু বছর আগে রাত হলেই কৃষিজীবী মানুষদের গোয়ালে হানা দিত বাঘ, নেকড়ের মত শিকারি জন্তুর দল। ফলে গোয়ালের খুঁটিতে বাঁধা অসহায় অবস্থাতেই প্রাণ যেত বহু পোষ্য গবাদি পশুদের। এই অতর্কিত আক্রমণ থেকে গবাদি পশুদের বাঁচাতে, তাদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতেই শুরু হয়েছিল এই উৎসবের। পূর্বপুরুষদের প্রথা মেনে আজও বাঁকুড়ার শহরতলি এবং গ্রামাঞ্চলে মূলত আদিবাসী প্রধান গ্রামগুলিতে পালিত হয় এই গরু খুঁটা উৎসব। আর এই উৎসব দেখতে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিড় জমান অজস্র মানুষজন।
