২১-এর বিধানসভা ভোটে জোট করে ভোট লড়ে বিধানসভা থেকে শূন্য হয়ে গিয়েছিল বাম ও কংগ্রেস। ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি ছাড়া রাজ্য বিধানসভায় শাসক তৃণমূল আর বিরোধী বিজেপি। রাজ্য বিধানসভায় মেরুকৃত রাজনীতির ছবিটা যখন ক্রমশই দীর্ঘ হচ্ছে, তখন, সাগরদিঘির উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের জয় একটা পরিবর্তনের দিক নির্দেশ করেছিল। রাজনৈতিক মহলের চর্চায় যার নাম ”সাগরদিঘি মডেল”। কিন্তু, তিন মাস কাটতে না কাটতেই সাগরদিঘির পালা বদলে রাজ্য রাজনীতিতে সাগরদিঘি মডেল ও সেই পরিবর্তনের স্থায়িত্ব নিয়ে আবার প্রশ্ন তুলে দিল।
advertisement
আরও পড়ুন: বায়রনে বিশ্বাস রেখে কি ভুল হল, দলবদলের পর কী বলছে সাগরদিঘি?
সাগরদিঘিতে কংগ্রেসের জয়কে স্বাগত জানিয়েছিল বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, বিজেপির ওখানে জেতার মতো পরিস্থিতিতে ছিল না। তাই আমরা চেয়েছিলাম, ওখানে তৃণমূল হারুক। এটা বিজেপির নৈতিক জয়। কিন্তু, শুভেন্দুর এই কৌশলকে ‘ সঠিক ‘ বলে মনে করেনি বিজেপির একাংশ। তাদের যুক্তি ছিল, নিজের নাক কেটে, তৃণমূলকে হারাতে গিয়ে লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরে যেতে হয়েছে বিজেপিকে। ২১-এর নির্বাচনে রাজ্যে তৃণমূল – বিজেপির মেরুকৃত রাজনীতির যে পটভূমি তৈরি হয়েছিল, সাগরদিঘির নির্বাচনে তা হারিয়ে বসে বিজেপি।
রাজনৈতিক মহলের মতে, আজ বায়রনের তৃণমূলে যোগদানে সে কারণেই খুশি চেপে রাখতে পারেননি বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত। ঘটনার প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে সুকান্ত বলেন, ” প্রচারে গিয়ে আমি বলেছিলাম, বাইরন জিতলেও, জেতার পর তৃণমূলে যাবে। আজ সে কথাই সত্যি হল।” রাজনৈতিক মহলের মতে, কংগ্রেসের টিকিটে জিতলেও, তিন মাসের মধ্যে শাসক দলে যোগ দেওয়া এটাই প্রমাণ করল, রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিসরে বহুদলীয় রাজনীতির কোনও সুযোগ নেই। বিজয়ী হলেও তৃণমূল বা বিজেপির ছত্রছায়ায় থাকতে হবে। এটাই বাস্তব। ” সাগরদিঘি সেই বাস্তবতাকে ভেঙে দিতেই নড়ে গিয়েছিল তৃণমূল ও বিজপির আস্থা।
তৃণমূল বুঝেছিল, ৬০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট থাকলেও সেখানে তৃণমূল হারতে পারে। আর, বিজেপি বুঝেছিল, ‘নো ভোট টু মমতা’ হলে রাজ্যে ‘তৃণমূল বনাম বিজেপি’ এই মেরুকৃত রাজনীতি সম্ভব হবে না। ২৪- এর লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক মেরুকরণ দরকার। তাই সাগরদিঘির পালাবদল খুবই জরুরি ছিল তৃণমূল, বিজেপির কাছে।
সাগরদিঘি মডেলকে সামনে রেখে রাজ্য রাজনীতিতে যে চর্চা শুরু হয়েছিল, সাময়িকভাবে বাম, কংগ্রেস তার সুফল পেলেও, সেটা স্থায়ী হয়নি। কারণ, সাগরদিঘির প্রার্থীকে ঘিরে সংশয় ছিল আগাগোড়াই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিধায়ক হিসাবে বিধানসভায় শপথ নিলেও, সাগরদিঘিতে বা তার জেলার কোনও দলীয় কর্মসূচিতেই বাইরনকে সামিল করা যাচ্ছিল না। কখনও অসুস্থতা, কখনও আবার অন্য কারণ দেখিয়ে কার্যত কংগ্রেসের থেকে দূরত্ব তৈরি করে রেখেছিলেন বাইরন।
সূত্রের মতে, জয়ের পরে বাইরনের এই দলবদল ছিল সময়ের অপেক্ষা। সলতে পাকানোর কাজ চলছিল আগেই। তার ইঙ্গিত ছিল নবজোয়ার কর্মসূচিতে অভিষেকের সভায়। অভিষেক বলেন, আমরা সাগরদিঘির উন্নয়ন চাই। সেখানকার কংগ্রেসের বিধায়ক এলাকার উন্নয়ন চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাতেই পারেন। এর পরেই, অভিষেকের ডাকে সাড়া দিয়ে বায়রন বলেন, সাগরদিঘির উন্নয়নের দাবিতে আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব। ১১ মে আমি কলকাতায় যাব। এ বিষয়ে দলের নেতৃত্বের কাছে অনুমতি চাইব।” বায়রনের এই মন্তব্য শুনে প্রদেশ দফতরে বসে সেদিন হেসে ছিলেন অধীররঞ্জন চৌধুরী। ফলে, আজ বায়রনের দলবদল হয়তো সে কারণেই কংগ্রেসের কাছে ‘অপ্রত্যাশিত’ ছিল না।
বায়রনের দলবদলে তাই ব্যক্তিগত আক্রমণে না গিয়ে অধীর নিশানা করেছেন মমতাকে। তৃণমূলের কংগ্রেসকে ভাঙার রাজনীতিকে লক্ষ্য করে অধীর বলেছেন, “ওয়ান সোয়ালো ডাস নট মেক এ সামার। অর্থাৎ, এক মাঘে শীত যায় না।” তবে, জবাবে, তৃণমূলের কুণাল ঘোষের মন্তব্য , এটা আসলে পরাজিতের আর্তনাদ। এ রাজ্যে কংগ্রেস যতই তৃণমূলকে উৎখাত করতে বাম, বিজেপির সঙ্গে জোট করুক না কেন, তাতে শীত কেটে বসন্ত আর আসবে না।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, শীত কেটে বসন্ত আসবে কি না সেটা ভবিষ্যত বলবে। তবে রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূল, বিজেপির বাইরে বিকল্প মডেল হিসাবে বাম – কংগ্রেসের সাগরদিঘি মডেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ণ রয়েই গেল।