তৎকালীন সময়ে কলিকাতা থেকে দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবনের লাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ব্যবসা বাণিজ্য । গাঙ্গেয় জমিতে ধানের সুফলের জন্য ফলতায় বিশাল ধানের আড়ত ছিল এবং ধান ব্যবসার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। বিহারীলাল দেব প্রতিষ্ঠা করেন কুলদেবতা শ্রী শ্রী লক্ষ্মীজনার্দন জিউর মন্দির। পরে ব্যবসা এবং জমিদারি বৃদ্ধির পর বিহারীলাল দেবের পুত্র কালীকৃষ্ণ দেব বাংলার ১১৫২ সালে প্রথম এই অঞ্চলে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন।
advertisement
পরে প্রজাদের মৈত্রী এবং মিলনের জন্য বাংলার নববর্ষের সময় গোষ্ঠ মেলার প্রচলন করেন । পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ” সরকার ” – উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকে এলাকায় ‘দেব সরকার’ নামে পরিচিত হয় এই পরিবার। এই দেব সরকার বাড়িতে দুর্গাপূজার সময় আমন্ত্রিত থাকতেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবেরা । দুর্গা মঞ্চের সামনে সুবিশাল আটচালা নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই আটচালাতে দুর্গাপুজোর সময় সাতদিন ব্যাপী যাত্রাপালা ও কবিগান হত ।
স্বদেশি আন্দোলনের সময়কালে দেব সরকার বাড়ির দুর্গাপুজোতে চারণ কবি মুকুন্দ দাস কবি গান গেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে স্বদেশে আন্দোলনের পৃষ্ঠভূমি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এই দেব সরকার বাড়ি। জমিদারি প্রথা আর নেই। এখন বড় রাজপ্রাসাদের গায়ে জমেছে আগাছার জঙ্গল। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে দেব সরকার বাড়ির ঠাকুরদালানের এক অংশ। অতীতের সেই ঐতিহ্য এখনও পর্যন্ত ধরে রেখেছে দেব সরকার বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা।
জৌলুসে ভাটা পড়লেও এখনও সেই রীতিনীতি বহাল রয়েছে। দেব সরকার বাড়ির দুর্গাপুজো এ বছর ২৭৯ তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। প্রতি বছর জন্মাষ্টমীর পরের দিন অর্থাৎ নন্দোৎসবের দিন প্রাচীন কাঠামোর উপর ‘কাঠামো পূজা’ করা হয়। এখানে প্রতিমা একচালার উপর হয়। একটি সুপ্রাচীন বেল গাছে দেবীর বোধন হয়। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত ১৩১ কিলোগ্রাম চালের নৈবেদ্য হয় । মল্লিকপুরের চক্রবর্তী পরিবার এই দেব সরকার বংশের কুলপুরোহিত । কিন্তু পরবর্তী কালে, বেলসিংহার মৈত্র পরিবার এই পূজার পৌরোহিত্য করেন।
বর্তমানে, মৃৎশিল্পী শ্রীকান্ত চিত্রকর বংশ পরম্পরায় এখানে মূর্তি নির্মাণ করেন। আর ঢুলিদাররা বংশ পরম্পরায় চাঁদপালার অদূরে সন্তোষপুর থেকে আসেন। গ্রামের সাধারণ মানুষ এই দুর্গোৎসবের আনন্দ আস্বাদন করতেন। দুর্গাপূজার দিনগুলোতে দেব সরকার বংশের সমস্ত পরিবার পরিজন দেশ বিদেশ থেকে মালা গ্রামে আসেন। পূজার ক’দিনের জন্য।
এ বিষয়ে দেব সরকার বাড়ির এক সদস্য তাপস কুমার দেব সরকার বলেন, ‘‘জমিদারি প্রথা আর নেই। আর্থিক সংকটের মধ্যে পুজোর জৌলুসে ভাটা পড়েছে। বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা এই পূজার হাল ধরেছে। নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত থাকে পরিবারের সদস্যরা।’’
পরিবারের অন্যতম মহিলা সদস্য স্মৃতি রেখা দেব সরকার জানান, ‘‘ পুজোর চারটে দিন আমরা চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটাই।নৈবেদ্য থেকে শুরু করে পুজোর অন্যান্য কাজে পুরুষদের পাশাপাশি পরিবারের মহিলা সদস্যরাও হাত লাগান। পরিবারের যে সকল সদস্যরা দেশে বা বিদেশে রয়েছেন তাঁরা পুজোর দিগুলিতে এই দেশের বাড়িতে ফেরেন। প্রচুর আনন্দে আমরা এই পূজাকে উপভোগ করি। বিশেষ করে দশমীর দিন সিঁদুরখেলা।ঐতিহ্যবাহী দেব সরকার বাড়ি স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে। দেব সরকার বাড়ির প্রাচীন সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা এগিয়ে এসেছে।’’