আগে ম্যাথিউ থাকতেন বেজিংয়েই। তাঁর দাবি, ২০২০ সালে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের সম্মত দাম নিয়ে একটি ইলেকট্রনিক্স মার্কেটের এক দোকানদারের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি।
আর তারপরেই সেই ঘটনায় তাঁকে অন্যায় ভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। বিবিসি-র প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে যে, ম্যাথিউ-র অভিযোগ, চিনা আইনি ব্যবস্থায় ১০০ শতাংশ দণ্ডাদেশের হার রয়েছে, আর তাতে নিজের নির্দোষ হওয়ার বিষয়টা প্রমাণ করতে যাওয়াটা একেবারেই ভিত্তিহীন। এমনটাই বলা হয়েছিল তাঁকে। এরপর ম্যাথিউকে একটি ভুয়ো স্বীকারোক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়েছিল। আদালতের নথিপত্র থেকে ইঙ্গিত মিলেছে যে, এই স্বীকারোক্তির কারণে অবশ্য তাঁর শাস্তি ৪ বছর কমানো হয়েছে।
advertisement
আরও পড়ুন: আইপিএস অফিসার হতে চান? যোগ্যতা কী? পরীক্ষার পদ্ধতি-পাঠ্যসূচি নিয়ে বিশদে জেনে প্রস্তুতি শুরু করুন
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বেজিং নম্বর ২ হয়ে ওঠে ম্যাথিউর ঠিকানা। এটি আবার আন্তর্জাতিক নাগরিকদের জন্য ব্যবহৃত কারাগার। একটি নোংরা সেলে আরও অন্যান্য জেল বন্দির সঙ্গে থাকতে হত ম্যাথিউকে। ফলে ঘুম হত না। জোর করে খাটানো হত।
চিনা কারাগারে কেমন জীবন কাটাতেন ম্যাথিউ?
অভিযোগে ম্যাথিউ বলেন, “আমি যখন এখানে এসেছিলাম, তখন আমার চেহারার হাল খুবই খারাপ ছিল। আমায় টানা ২ দিন ধরে মারধর করা হয়েছিল। প্রথমে যে থানায় ছিলাম, সেখানেও মারধর করা হয়। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা ধরে দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। খাবার এমনকী জলটুকুও জোটেনি। এরপর আমায় দিস্তা দিস্তা নথিপত্রে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছিল।” পেশায় ভিডিও প্রযোজক ম্যাথিউ জানান যে, তাঁকে একটি ভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে কয়েক মাস কাটাতে হয়েছিল। সেখানেও প্রচণ্ড অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। বিবিসি-র কাছে ম্যাথিউ বলেছেন যে, স্নান করা এবং নিজেদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার উপর সেখানে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কখনও কখনও এই বিষয়টা মাসের পর মাস চলত। এমনকী নির্দিষ্ট বরাদ্দ সময়ের জন্যই শৌচাগার ব্যবহার করা যেত। আর সেই শৌচাগারের অবস্থাও ছিল শোচনীয়। শৌচাগারের বর্জ্য ক্রমাগত আমাদের উপর পড়তে থাকত।
এরপর অবশ্য ম্যাথিউকে রেগুলার প্রিজনে ট্রান্সফার করা হয়। আর সেখানে উপচে পড়ত জেলবন্দিদের ভিড়। সারা দিন-সারা রাত জ্বলত আলো। একই ঘরে বসে খাওয়া আর ঘুম দিতে হত। জেলের বেশিরভাগ বন্দিদের মধ্যে ছিলেন আফ্রিকান এবং পাকিস্তানি। কিছু কিছু বন্দি আবার আফগানিস্তান, ব্রিটেন, আমেরিকা, উত্তর কোরিয়া এবং তাইওয়ানেরও নাগরিক। তাঁদের বেশিরভাগই মাদক চোরাকারবারি হিসেবে কাজ করার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
ভাল ব্যবহার করলে মিলবে পয়েন্ট:
ম্যাথিউ আরও জানান, চিনা কারাগারে ‘গুড বিহেভিয়ার পয়েন্টস সিস্টেম’-ও রয়েছে। এটা কারও শাস্তি কমানোর উপায়। বন্দিরা প্রত্যেক মাসে নানা ধরনের কার্যকলাপের মাধ্যমে ভাল আচরণের সর্বোচ্চ ১০০ পয়েন্ট পেতে পারতেন। এই কার্যকলাপগুলির মধ্যে অন্যতম হল – কমিউনিস্ট পার্টি সাহিত্য পাঠ, জেল কারখানায় কাজ এবং অন্যান্য বন্দিদের উপর নজরদারি।
যদি বন্দিরা ৪২০০ পয়েন্টের বেশি পয়েন্ট জড়ো করতে পারেন, তাহলে তাঁদের কারাবাসের সময় কমানো হবে। এর অর্থ হল, প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে প্রত্যেক মাসে তাঁদের সর্বোচ্চ পয়েন্ট জড়ো করতে হবে। তবে ম্যাথিউর মতে, এটা মানসিক অত্যাচারের একটা কৌশল মাত্র!
এর পাশাপাশি বন্দিদের ক্ষেতে কাজ করার জন্য বাধ্য করা হত। ম্যাথিউর দাবি, প্রচুর শাকসবজি ফললেও অবশ্য তা খাওয়ার অধিকার ছিল না তাঁদের। বরং মরশুমের শেষে উৎপাদিত সমস্ত সবজি একটি বড় গর্তে ফেলে তা চাপা দিয়ে দেওয়া হত। আর যদি কাউকে ক্ষেতে উৎপাদিত শসা কিংবা লঙ্কা খেতে দেখা যেত, তাহলে তাঁকে আট মাসের জন্য নির্জন কারাবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হত।
নির্জন কারাবাস:
ম্যাথিউ বলে চলেন, একবার আফ্রিকা এবং তাইওয়ানের বন্দিদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল। কারণ নাইজেরিয়ার বন্দিরা রান্নাঘরে কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। যার জেরে তাঁরা ছোট ছোট সুবিধাও পাচ্ছিলেন। সেই সময় জেল রক্ষীকে বুঝিয়েসুঝিয়ে রান্নাঘরের কাজের দায়িত্ব চেয়েছিলেন তাইওয়ানের বন্দিরা। যার জেরে তীব্র ঝামেলা হয়েছিল। আর এর মাঝে পড়ে গিয়েছিলেন ম্যাথিউ নিজেও। অন্য এক বন্দিকে আঘাত করার দায়ে ১৯৪ দিনের জন্য তাঁকে নির্জন কারাবাসে পাঠানো হয়েছিল।
সেই কারাগারে ছিল নামমাত্র আলো। আধপেটা খাবার খেয়েই দিন গুজরান হত ম্যাথিউর। এমনকী সেখানে থাকাকালীন কথা বলার সঙ্গী পর্যন্ত ছিল না তাঁর। চার মাস পর থেকে অবশ্য নিজের সঙ্গেই সব সময় কথা বলতে শুরু করেছিলেন তিনি।
আর এই সমস্ত ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা গোপনে লিখে জার্নালের মাধ্যমে সংরক্ষণ করেছেন ম্যাথিউ। আর লেখার জন্য তিনি ব্যবহার করতেন কোভিড-১৯-এর মাস্কের ছেঁড়া টুকরো। আর ছোট ছোট অক্ষরে লেখার জন্য তিনি সাহায্য নিতেন উত্তর কোরিয়ার বন্দিদের। ২০২৪ সালের ৫ অক্টোবর সেই জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে পর্যন্ত তা সযত্নে নিজের পুরনো জ্যাকেটের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
মুক্তির পর অস্ট্রেলিয়া ফিরে গিয়েছিলেন ম্যাথিউ। আর পার্থ বিমানবন্দরে পৌঁছেই জড়িয়ে ধরেছিলেন নিজের বাবাকে। পরে অবশ্য দীর্ঘদিনের প্রেমিকাকে বিয়ে করে সংসারও পেতেছেন ম্যাথিউ। স্বামী-স্ত্রী মিলে মোমবাতি এবং অন্যান্য জিনিস তৈরি করেন। তবে চিনের কারাগারে কাটানো মুহূর্ত এখনও তাড়া করে বেড়ায় ওই যুবককে। জেলে থাকা সঙ্গীদের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন তিনি।