চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই রাজস্থান থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে নিজের মেয়াদ শেষ করেন মনমোহন সিং৷ এর আগে ১৯৯১ সাল থেকে টানা ছ বার অসম থেকে রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন মনমোহন৷ রাজ্যসভায় মনমোহনের শেষ দিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে অনুপ্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রশংসায় ভরিয়েছিলেন৷
আরও পড়ুন: ‘আর্থিক নীতি নির্ধারণে জোরাল ছাপ রেখে গেলেন’, অগ্রজ মনমোহনের প্রয়াণে শোকবার্তা মোদির
advertisement
সেদিন নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, দীর্ঘ সময় ধরে মনমোহন সিং যেভাবে দেশকে পথ দেখিয়েছেন, তাতে যখনই ভারতীয় গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হবে, তখন হাতে গোনা যে কয়েকজন শ্রদ্ধেয় নেতার কথা মনে করা হবে, তাঁদের মধ্য মনমোহন সিং অন্যতম৷
বরাবরই রাজনীতিতে অনিচ্ছুক অর্থনীতিবিদ হিসেবেই দিল্লির রাজনীতিতে পরিচিত ছিলেন মনমোহন সিং৷ প্রথম ইউপিএ সরকারের সময়ে ভারত-আমেরিকা পরমাণু চুক্তি এবং তার জেরে জাতীয় রাজনীতিতে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল, তা দক্ষ হাতেই সামাল দিয়েছিলেন মনমোহন৷ দশ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালে যা মনমোহন সিংয়ের অন্যতম সাফল্য হিসেবেই গণ্য করা হয়৷ সেই সময় বামেরা ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের পর আস্থাভোটের মুখোমুখি হতে হয় মনমোহন সরকারকে৷ কার্যত একার উদ্যোগে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের সমর্থন জোগাড় করেছিলেন মনমোহন৷
তবে ভারতীয় রাজনীতিতে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী মনমোহন সিংকে গোটা দেশ মনে রাখবে ১৯৯১ সালে পি ভি নরসিমহা রাওয়ের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী হিসেবে ভারতীয় অর্থনীতির সংস্কারের জন্য৷ ১৯৯১ সালে বিশ্বের দরবারে ভারতীয় অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন এই মনমোহনই৷ আস্থাভাজন তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাও৷
১৯৯১ সালে ধুঁকতে থাকা ভারতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কৃতিত্ব যেমন মনমোহন সিংকে দেওয়া হয়, সেরকমই ২০০৪ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতের বিদেশ নীতিতেও আমূল বদল এসেছিল৷
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমেরিকার মতো বিশ্বের তাবড় শক্তিধর দশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করার উপরে জোর দেন মনমোহন সিং৷
১৯৩২ সালের ২৬ ডিসেম্বর অবিভক্ত পঞ্জাবের বাহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মনমোহন সিং৷ দেশভাগের জেরে নানা বিধ সমস্যয় পড়া অনেকেই যেভাবে পরবর্তী সময়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছাপ ফেলেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মনমোহন সি৷
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন বরাবরের মেধাবী ছাত্র মনমোহন৷ এর পর ১৯৬০-র দশকের প্রথম দিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি ফিল করেন মনমোহন৷ অর্থনীতিবিদ হিসেব ভারতের বিভিন্ন শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে আসীন ছিলেন মনমোহন৷ ১৯৯১ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার আগেও প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা, প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভ্নরর মতো গুতরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেম৷ সম্ভবত এই সমস্ত কারণেই গোটা বিশ্বেই সমাদৃত ছিলেন মনমোহন৷ ২০১০ সালের জি টোয়েন্টি সম্মেলন চলাকালীন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও গভীর জ্ঞানের জন্য মনমোহন সিংয়ের প্রশংসাও করেছিলেন৷
সারা জীবন স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ধরে রাখা মনমোহন সিংকেও অবশ্য তাঁর সরকারের আমলে টুজি, কয়লা বণ্টন, কমনওয়েলথ কেলেঙ্কারির জন্য অস্বস্তির মুখে পড়তে হয়েছিল অন্যদিকে একটানা মুদ্রাস্ফীতি এবং মূল্যবৃদ্ধির জেরে মনমোহন সিং সরকারের উপরে ক্ষোভ জন্মায় সাধারণ মানুষের৷ শিল্প ক্ষেত্রও মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে নীতি পঙ্গুত্বের অভিযোগ তুলতে থাকে৷ ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন মনমোহন সিং আমেরিকা সফরে রয়েছেন, তার মাঝেই ভারতে একটি বিতর্কিত অর্ডিন্যান্স নিয়ে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ্যে আনেন কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধি৷ এই ঘটনার পর বিজেপির প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীও কটাক্ষ করে মনমোহন সিং-কে দুর্বলতম প্রধানমন্ত্রী বলে ফের একবার বিঁধেছিলেন৷ বিজেপি শিবিরের বরাবরই অভিযোগ ছিল, মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হলেও রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে তাঁকে পরিচালনা করতেন তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধি৷
তবে এর বিরোধী মতও রয়েছে৷ ২০০৮ সালে দলনেত্রীর মতের বিরুদ্ধে গিয়েই আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে সই করে নিজের সরকারের ভবিষ্যতই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছিলেন মনমোহন সিং৷ প্রথম ইউপিএ সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে বামেরা৷ তার পরেও অবশ্য ২০০৯-এ ফের ক্ষমতায় ফেরে ইউপিএ সরকার৷ সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়, সিং ইজ কিং৷ একই ভাবে ২০০৯ সালের জুলাই মাসেও নিজের দলের সিদ্ধান্তের কার্যত বিরুদ্ধে গিয়েই পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির সঙ্গে চুক্তি সইয়ের ঝুঁকি নিয়েছিলেন মনমোহন সিং৷
এর পরে অবশ্য টুজি কেলেঙ্কারির মতো দুর্নীতির অভিযোগ, ক্যাগ রিপোর্ট বিপক্ষে যাওয়া, অন্না হাজারের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনস ২০১২ সালে দিল্লিতে নির্ভয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের মতো একের পর এক ঘটনা কংগ্রেসের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল৷ টান পড়েছিল জনসমর্থনে৷ যার ফলস্রুতিতে ২০১৪-র ভোটে কার্যত ধুয়ে মুছে গিয়েছিল কংগ্রেস৷
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের শেষ সাংবাদিক বৈঠকে মনমোহন হয়তো কিছুটা আক্ষেপের সুরেই বলেছিলেন, ‘সংবাদমাধ্যম বা সংসদে বিরোধী দলগুলি আমার প্রতি যতটা নির্দয় হয়েছে, আমি মন থেকে বিশ্বাস করি ইতিহাস আমার প্রতি ততটা নির্দয় হবে না৷’ মৃত্যুর পর তাঁকে ঘিরে যে স্বতঃস্ফূর্ত শোকের প্রবাহো গোটা দেশজুড়ে দেখা গেল, তাতে হয়তো এক দশক আগে নিজের বলা কথাগুলিকেই সত্যি প্রমাণ করে গেলেন মনমোহন সিং৷