কর্ণাটক নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর বিজেপির অন্দরে একদিকে যেমন মোদি ম্যাজিক নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তেমনই অনেকেই মনে করছেন, কর্ণাটক নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ে শুধু মোদি ম্যাজিকই নয়, ‘ফ্লপ’ করছে বিজেপির ‘চাণক্য’ অমিত শাহ ‘এর ‘শাহি কৌশলও’।
আরও পড়ুন: সব দাপট উধাও, সুকন্যাকে দেখেই হাউ হাউ করে কেন কান্না অনুব্রতর? সাক্ষী থাকল তিহাড় জেল
advertisement
দলের একাংশের মতে, কর্ণাটকে দলের সাফল্য নিয়ে সংশয় ছিল বরাবর। বিজেপি নেতৃত্বাধীন শাসক দলের দুর্নীতি থেকে প্রচারের মুখ ঘোরাতে মেরুকরণ থেকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ এর মতো অস্ত্রকেও ব্যবহার করেছে বিজেপি। নির্বাচনী প্রচারে মোদির ক্যারিশমাকে যুক্ত করেও শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতে হয়েছে দলকে।
সম্প্রতি, অনেকটা একই পরিণতি হয়েছে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডার হিমাচলে। সেখানেও, ক্ষমতাসীন বিজেপিকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেস। হিমাচলের ফল প্রকাশের পর তাই দলের মধ্যেই গুঞ্জন তৈরি হয়েছিল নাড্ডার নেতৃত্ব নিয়ে। যদিও, নিন্দুকদের আশায় ছাই দিয়ে নাড্ডার মেয়াদ বৃদ্ধি করেছেন মোদি, শাহরা।
এবার, কর্ণাটকে দলের পরাজয়ের পর একইভাবে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বি এল সন্তোষের বিরুদ্ধেও নাকি আঙুল উঠতে শুরু করেছে। কর্ণাটক তো বটেই, দেশজুড়ে বিজেপি প্রভাবিত সমাজ মাধ্যমে কর্ণাটকে পরাজয়ের জন্য পরোক্ষে সন্তোষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো শুরু হয়ে গিয়েছে। যদিও, এ বিষয়ে সরকারি ভাবে দলের পক্ষ থেকে কোনও মন্তব্য করা হয় নি। বরং, কর্ণাটকে দলের পরাজয়কে কোনও ব্যক্তি বিশেষের ঘাড়ে চাপাতে নারাজ দল। রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “জয় – পরাজয় কোনওটাই আমরা ব্যক্তিগত কৃতিত্ব বলে দাবি করি না। এটা দলের সার্বিক সিদ্ধান্ত। কর্ণাটকের পরাজয় নিয়েও দলে আলোচনা করে তা থেকে শিক্ষা নিয়েই আগামী দিনে এগোবে দল।”
তবে, দলের একাংশের মতে, সমালোচকদের আক্রমণের লক্ষ্য সন্তোষ হলেও, আসল লক্ষ্য সন্তোষ নন, সন্তোষকে সামনে রেখে তারা আসলে অমিত শাহকেই নিশানা করতে চান। কারণ, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে উন্নীত হওয়ার আগে ৪ বছর সন্তোষ ছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় যূগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ২০১৯- এর ১৩ জুলাই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সংগঠন রামলালকে সরিয়ে ওই পদে তাঁকে বসান সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ।
৮ বছর কর্ণাটকে দলের সংগঠনের দায়িত্ব সামলানোর পর, মোদি- অমিত শাহের জামানাতেই সন্তোষ কেন্দ্রীয় সংগঠনের দায়িত্ব পান। ২০২৩- এ কর্ণাটকের গুরুত্বপূর্ন নির্বাচনে, তাঁর পুরনো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যে দলের সংগঠনের হাল ফেরাতে শাহের অন্যতম তুরুপের তাস ছিলেন সন্তোষ। সূত্রের খবর, ২০২৩-এ কর্ণাটক নির্বাচনের মুখে দলীয় কোন্দল ঠেকাতে কর্ণাটকের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নেতা বি এস ইয়েদুরাপ্পাকে ও বি এল সন্তোষ -এর সঙ্গে একসাথে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন অমিত শাহ। যদিও, পর্যবেক্ষকের মতে, ইয়েদুরাপ্পার সঙ্গে সন্তোষের ভাঙা সম্পর্ক তাতে জোড়া লাগেনি।
২০১৯-এ দলকে রাজ্য ক্ষমতায় ফেরানোর পর মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছিলেন ইয়েদুরাপ্পা। কিন্তু, রাজ্যে দলের কোন্দল নিয়ে বারবার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের জেরে বয়সের কারণ দেখিয়ে ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে একপ্রকার বাধ্য করা হয়। দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটির এই সিদ্ধান্তের পিছনে বি এল সন্তোষের হাত ছিল বলে কর্ণাটকে ইয়েদুরাপ্পার অনুগামীরা মনে করেন।
আরও পড়ুন: হারের দায় মোদির নয়, কর্ণাটক নিয়ে মুখরক্ষায় পাল্টা যুক্তি বিজেপি-র
ইয়েদুরাপ্পা শিবিরের মতে, রাজ্য রাজনীতিতে সন্তোষের সঙ্গে ইয়েদুরাপ্পার দীর্ঘ বৈরিতা সুবিদিত। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই দলীয় পদ ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এ কাজ করেছিলেন শাহের ঘনিষ্ট বি এল সন্তোষ। দলীয় এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের আর্জি ছিল একান্তই যদি ইয়েদুরাপ্পাকে সরাতে হয়, তাহলে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর পূর্ণ মেয়াদ শেষ হবার পরেই তা করা হোক। কিন্তু, সেই আর্জিতে কাজ হয় নি। ২০২১ সালের ২৬ জুলাই কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন ইয়েদুরাপ্পা। আর, এর একবছর পরেই ইয়েদুরাপ্পা রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ইয়েদুরাপ্পার এই ঘোষণা যাতে কর্ণাটক বিজেপিতে ক্ষোভ আর না বাড়ায় তাই তড়িঘড়ি তাঁকে মোদি, অমিত শাহদের সঙ্গে দলের নীতি নির্ধারক সর্বোচ্চ কমিটির সদস্য করে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলের’ চেষ্টা হয়।
এদিকে, ইয়েদুরাপ্পার উত্তরসূরি বোম্মাই-এর নেতৃত্বেও ২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনে আসন বণ্টন নিয়ে জটিলতার জেরে জগদীশ শেট্টারের মতো প্রবীন নেতা ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদান করেন। এই ঘটনার পিছনে ইয়েদুরাপ্পা শিবিরের হাত ছিল বলে মনে করে দলের একাংশ। অতীতে রাজ্যের লিঙ্গায়েত ভোটকে বিজেপির ঝুলিতে নিয়ে আসার পিছনে ইয়েপদুরাপ্পা ও শেট্টার একযোগে কাজ করেছিলেন। এবার, নির্বাচনের আগেই কর্ণাটকের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এই লিঙ্গায়েত ভোটের নিরঙ্কুশ আধিপত্যে ফাটল ধরেছিল বিজেপিতে।
কর্ণাটকের নির্বাচনী প্রচারে, শাহের মেরুকরণের রাজনীতি আর মোদি ম্যাজিকেও যার শেষ রক্ষা করা যায়নি, বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, দক্ষ্মিণ ভারতে একমাত্র কর্ণাটকেই ক্ষমতায় ছিল বিজেপি। ২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে কর্ণাটকে আবার ক্ষমতায় ফেরা তাই দক্ষ্মিণ ভারত সহ দেশের রাজনীতিতে বিজেপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদিও, ভোটের আগেই কর্ণাটক জয় যে বিজেপির কাছে খুব সহজ হবে না তা টের পাচ্ছিল বিজেপি। সে কারণেই এই অসাধ্য সাধনের দায় আরএসএস-এর বিশ্বস্ত সৈনিক,কর্ণাটকের রাজনীতিতে অভিজ্ঞ, সর্বভারতীয় সাধাণ সম্পাদক বি এল সন্তোষের উপর অনেকটা ভরসা করেছিলেন মোদি, শাহেরা। কিন্তু, শাহের সেই আস্থার প্রতি সুবিচার করতে পারলেন না সন্তোষ।