প্রথমেই বলব, তাঁরা নিয়মিত যে ওষুধ খান, সেটা হাঁপানির হতে পারে, সিওপিডি-র হতে পারে, সেই ওষুধ খাওয়ার রুটিনে যেন কোনও খামতি না থাকে৷ ওষুধ খাওয়া যেন বাদ না পড়ে৷ দ্বিতীয়ত, মাস্ক, স্যানিটাইজেশন এবং সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মানতে হবে অক্ষরে অক্ষরে৷ তৃতীয়ত এখন সিজন চেঞ্জের সময়৷ এ সময় অ্যালার্জিক ম্যানিফেস্টেশন অনেক বেড়ে যায়৷ তাই অ্যাজমা (Asthma) এবং সিওপিডি-র (COPD) রোগীদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে৷ যাঁদের এখনও বাড়াবাড়ি রকমের কিছু হয়নি, তাঁদের বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে৷
advertisement
বাড়তি সতর্কতা বলতে?
হঠাৎ গরম পড়ে গিয়েছে বলে গরম জামা খুলে ফেললে চলবে না৷ গলা, কান ঢাকতে হবে ঠিকমতো৷ খুব ভোরে বা সন্ধ্যাবেলা হাঁটতে যাওয়া চলবে না৷ অর্থাৎ সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের পরে হাঁটতে যাবেন না৷ কারণ কলকাতার একিউআই (AQI) বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (Air Quality Index) ভাল নয়৷ তাই দিনের ওই দুই সময়ে দূষণ থেকে সংক্রমণ ঘটতে পারে৷ এখন থেকে অন্তত মার্চ-এপ্রিল অবধি মর্নিংওয়াক ও ইভনিংওয়াক করুন সূর্যালোকে৷ এ ছাড়া বিভিন্ন ক্রনিক রোগের রোগীদের আমরা বলি দু’টি ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য৷
কোন ভ্যাকসিন?
একটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন, যেটা বছরে এক বার নিতে হয়৷ আর একটা নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন, যেটা দু’ ধরনের ভ্যাকসিন হয়৷ সাধারণত ৫ বছর অন্তর নিতে হয়৷ যে চিকিৎসক দেখছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলে, তাঁর পরামর্শমতো এই দু’টি টিকা নিয়ে নিতে হবে৷ একই সঙ্গে আরও একটা কথা মনে করিয়ে দেব৷
আরও পড়ুন : ‘ডাবল মাস্ক ছাড়া বাড়ির বাইরে পা রাখবেন না’, পরামর্শ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের
কী কথা?
অনেকেই ভাবেন টিকা নিয়েছি মানে, আমার ইনফ্লুয়েঞ্জা বা নিউমোনিয়া হবে না৷ তা কিন্তু নয়৷ ভ্যাকসিন কিন্তু রোগ আটকায় না৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়৷ একই কথা প্রযোজ্য কোভিড টিকার ক্ষেত্রেও৷ যাঁরা দু’টো ডোজ নিয়েছেন তাঁরা বুস্টার ডোজ নিন৷ যাঁরা এখনও টিকা নিতে দ্বিধা করছেন, তাঁদের সামনে বড় দৃষ্টান্ত কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গ৷ সংক্রমণের হার বেশি হলেও এই ওয়েভে মৃত্যুহার অত্যন্ত কম৷ তাই সব দ্বিধা কাটিয়ে টিকা নিন৷ এগুলি সুস্থতার বেসিক প্রোটোকল৷ ক্রনিক রেসপিরেটরি প্রবলেম (Chronic Respiratory Disease) যাঁদের আছে, তাঁরা এই পরিস্থিতিতে এ নিয়মগুলি মেনে চলুন৷
ডায়েটের দিকে কোন কোন বিষয় খেয়াল রাখব?
যে কোনও রেসপিরেটরি ডিজিজ-এর বেসিক প্রোটোকল হল, ফ্রিজের ঠান্ডা জিনিস খাওয়া চলবে না৷ ফ্রিজের খাবার গরম করে বা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এনে তার পরই খান৷
এটা কি সারাবছরের জন্যই নিয়ম? নাকি শুধু শীতকালে?
না, সারা বছরই এই নিয়ম মেনে চলুন৷ এছাড়া যাঁদের কোভিড হয়নি, কিন্তু রেসপিরেটরি সমস্যা আছে, তাঁদের আমরা বলি কার্বোহাইড্রেটস তুলনামূলক ভাবে কম খেয়ে প্রোটিনজাতীয় খাবার বেশি করে খান৷ কারণ কার্বোহাইড্রেটের জন্য সামান্য হলেও শরীরের মধ্যে কার্বনডাইঅক্সাইড তৈরির প্রবণতা বেড়ে যায়৷ তার ফলে সিওপিডি রোগীদের অসুবিধে হতে পারে৷
আরও পড়ুন : ‘সাধারণ সর্দিকাশিতেও বাচ্চার সামনে মাস্ক পরে থাকুন’, মত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞর
যাঁদের কোভিড হয়ে গিয়েছে, তাঁদের জন্য কী বলবেন?
তাঁদের জন্য বাড়তি সতর্কতা হিসেবে ডায়েটে প্রচুর পরিমাণে জল রাখতে হবে৷ যদি কোনও কারণে ডায়েটে ফ্লুইড রেস্ট্রিকশন থাকে, তাহলে অন্য কথা৷ নয়তো সারা দিনে অন্তত আড়াই থেকে তিন লিটার ফ্লুইড ডায়েটে থাকতে হবে৷ সেটা জল, ফলের রস, দুধ-যে কোনও কিছু হতে পারে৷ মোট কথা, ডায়েটে আড়াই থেকে তিন লিটার ফ্লুইড থাকতে হবে৷
তাঁদেরও কি ডায়েটে প্রোটিনের পরিমাণ বাড়াতে হবে?
হ্যাঁ৷ দরকার হলে ডায়েটিশিয়ানের সঙ্গে কথা বলে ডায়েটচার্ট তৈরি করতে হবে৷ বেশি করে প্রোটিন খেতে হবে৷ কারণ কোভিডকে বলা হয় ক্যাটাবলিক ডিজিজ৷ এর ফলে শরীরে ‘মাসল প্রোটিন’ নষ্ট হয়ে যায়৷ কোভিড পরবর্তী সময়ে যে দুর্বলতা, সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্য বেশি করে প্রোটিন খাওয়া প্রয়োজন৷
স্নানের ব্যাপারে কিছু নিয়ম আছে?
যাঁরা ক্রনিক রেসপিরেটরি ডিজিজে আক্রান্ত, তাঁদের সারা বছর ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করা প্রয়োজন৷ অনেকেই গরমকালে এই নিয়ম মেনে চলতে পারেন না৷ তাঁরা অন্তত সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অন্তত এপ্রিলের মাঝামাঝি অবধি, ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করা দরকার৷ গরমকালেও কনকনে ঠান্ডা জল এড়িয়ে চলুন স্নানের সময়৷ স্নানের পর ভিজে গায়ে ফ্যানের তলায় বা এসি-তে বসা যাবে না কোনওমতেই৷
আরও পড়ুন : আপনার সন্তান ১৫-১৮ বছর বয়সি? জেনে নিন টিকা নেওয়ার জন্য কী কী করতে হবে
এটা তো সারা বছরের জন্যই প্রযোজ্য?
সারা বছরই এই নিয়ম মনে রাখতে হবে এবং মেনে চলতে হবে৷ ভিজে গায়ে, সেটা স্নান করে হতে পারে, ঘামে ভিজে যাওয়া হতে পারে বা বৃষ্টির জলে ভিজে যাওয়াও হতে পারে-ফ্যানের তলায় বা এসি-তে থাকা যাবে না৷ এই সমস্যা আমরা অল্পবয়সি রোগীদের মধ্যে বেশি দেখতে পাই৷
মানে যাঁরা অফিসে যাচ্ছেন, তাঁদের কথা বলছেন তো?
হ্যাঁ৷ হয়তো ঘামে ভিজে অফিসে ঢুকছেন, যেটা কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত৷ তাঁদের আমরা বলি, বাইরে থেকে এসে সোজা কিউবিকলে না গিয়ে আগে ওয়াশরুমে যান৷ দরকার হলে ঘামে ভেজা শার্ট চেঞ্জ করে তার পর কিউবিকলে ঢুকুন৷ কিন্তু সেটা তো সব সময় সম্ভব নয়৷ যদি সম্ভব হয়, তাহলে নাথিং লাইক দ্যাট৷ মহিলাদের বলব, স্নানের পর যত দ্রুত সম্ভব চুল শুকিয়ে নিন৷ চুলে জল জমে থাকতে দেওয়া যাবে না৷
এখন তো ঘরে ঘরে জ্বর৷ তা, জ্বর এলেই কি পরীক্ষা করব?
এখন যা পরিস্থিতি, প্রথম বা দ্বিতীয় দিনেই পজিটিভিটি চলে আসছে৷ আগে অনেক সময় চতুর্থ দিনে হয়তো পজিটিভিটি আসত৷ তাই আমার মনে হয়, জ্বর এলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষা করান৷ যদি কোভিড পজিটিভ হন, বাড়ির সকলের থেকে নিজেকে আইসোলেট করুন৷ ভিডিও কনসাল্টেশন করুন চিকিৎসকের সঙ্গে৷
ধরুন, আমার জ্বর এল৷ কিন্তু আমি জানি না কোভিড পজিটিভ কিনা৷ তাহলে জ্বর এলেই কি নিজেকে আইসোলেট করে নেব?
সেটাই করে নেওয়া ভাল৷ কারণ যদি কোভিড পজিটিভ হয়ে থাকে, তাহলে বাড়ির বাচ্চা এবং বয়স্করা সহজেই আপনার থেকে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন৷ তাই প্রথম থেকেই সতর্কতা নিন৷ যদি আপনি নিশ্চিত জানেন যে নির্দিষ্ট অন্য কোনও কারণে জ্বর এসেছে, সেটা আলাদা কথা৷ নয়তো প্রথম থেকেই সাবধানতা নেওয়া প্রয়োজন৷ তার পর টেস্ট করান এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন৷
আমরা যাঁরা সাধারণ মানুষ, তাঁরা অনেক সময়েই বলি, ‘‘আমার না শীতকালে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ধাত আছে৷’’ হয়তো দেখিও কারও কারও খুব সহজেই ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে সার্বিক সুস্থতার জন্য কী করব?
নিজস্ব অবজার্ভেশন খুব প্রয়োজন৷ অনেকেই আছেন, যাঁরা ‘ঠান্ডা লাগা’ ভেবে বসে আছেন৷ ভেবেও দেখছেন না তাঁরা ক্রনিক রেসপিরেটরি ডিজিজের শিকার কিনা৷ যদি দেখেন দীর্ঘদিন ধরে আপনি সিজন চেঞ্জের সময় সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তাহলে প্রথমেই একজন পালমোনলজিস্টের কাছে যান৷ আপনার সমস্যা চিহ্নিত করুন৷ তার পর চিকিৎসকের পরামর্শমতো প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন নিন, প্রথমেই যেমন বললাম এবং ওষুধ খান৷
ঠান্ডা লাগলে আমাদের মধ্যে বেশ কিছু ঘরোয়া টোটকা মেনে চলার প্রবণতা আছে৷ সে সব কি করা যাবে?
এই হোমমেড রেমেডি সবই বহু পুরনো এবং পরীক্ষিত৷ তাই অনুসরণ করা যেতেই পারে৷ কিন্তু মনে রাখতে হবে এগুলো সবই সাপোর্টিভ থেরাপি৷ আমি স্পেসিফিক থেরাপি না করে শুধু গরমজলে গার্গল করে গেলাম, তাতে কিন্তু রোগ সারবে না৷ স্পেসিফিক ট্রিটমেন্টের সঙ্গে কেউ যদি সাময়িক আরাম পাওয়ার জন্য ঘরোয়া টোটকা অনুসরণ করতে চান, করতে পারেন৷ তাতে অসুবিধে নেই৷ কিন্তু অসুখ চিহ্নিত করে সঠিক ও মূল চিকিৎসাপদ্ধতি মেনে চলা সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷