এই মরশুমে তো ঘরে ঘরে রক্তচক্ষু। এত কনজাংটিভাইটিস হওয়ার কারণ কী?
চোখের এই অসুখ প্রায় প্রতি বছরই কমবেশি হয়৷ সাধারণত দু’ ধরনের কনজাংটিভাইটিস হয়৷ একটা ভাইরাল, আর একটা ব্যাকটেরিয়াল৷ এ বার ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস বেশি হয়েছে৷ ব্যাকটেরিয়াল কম হয়েছে৷ ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে লোকে আক্রান্ত হয়েছেন ভাইরাল কনজাংটিভাইটিসে৷
দুটোর মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
advertisement
ভাইরাল কনজাংটিভাইটিস অনেক বেশি ছোঁয়াচে৷ সংক্রমণ বেশি ছড়ায়৷ সাধারণত অ্যাডিনো ভাইরাসই এর জন্য দায়ী৷ এতে চোখ লাল হয়ে যায়৷ কড়কড় করে৷ পিচুটি বার হতে পারে৷ সকালে ঘুম থেকে উঠে পিচুটিতে চোখের পাতা প্রায় আটকে যায়৷ অনেকের চোখ থেকে জলও পড়তে পারে৷ এক জনের থেকে অন্য জনের ক্ষেত্রে উপসর্গ আলাদা হতে পারে৷ কারণ ভাইরাসের অনেক রকম স্ট্রেইন হয়৷
সংক্রমণ সারতে কত দিন সময় লাগবে?
সেটাও কিন্তু নানা ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হতে পারে৷ কারওর দেখছি ৩-৪ দিনে সেরে গেল৷ কারওর আবার সময় লাগল ১ সপ্তাহ৷ অন্যান্য বার কিন্তু এর থেকে বেশি সময় লাগে৷ এরকমও দেখেছি ১৩ দিন লাগছে সংক্রমণ সম্পূর্ণ নিরাময় হতে৷ এ বছর সংক্রমণ বেশি ছড়াচ্ছে৷ কিন্তু উপসর্গের তীব্রতা কম৷
সেরে যাওয়ার পরও কি কোনও সমস্যা হতে পারে?
সেটা অন্যান্য বার দেখেছি৷ কনজাংটিভাইটিস সেরে যাওয়ার পরও হয়তো আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা হচ্ছে৷ বা দৃষ্টিশক্তি কিছুটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছে৷ কর্নিয়ায় স্পটও হতে দেখেছি৷ এ বার কিন্তু একজন রোগীর মধ্যেও এই সমস্যা দেখিনি৷
তাহলে এ বছর প্রধান যে সমস্যা, সেটা হল অত্যন্ত বেশি ছোঁয়াচে?
এই ছোঁয়াচের ক্ষেত্রে বলব, রোগ কিন্তু ছড়ায় শুধু স্পর্শ থেকে৷ আকাশ বাতাস থেকে নয়৷ ধরুন কারওর কনজাংটিভাইটিস হয়েছে৷ তিনি চোখে হাত দেওয়ার পর দরজার হাতল বা অন্য কোথাও হাত দিলেন৷ এর পর একজন সুস্থ ব্যক্তিও সেখানে হাত দিলেন৷ সেই হাতে নিজের চোখ মুছলেন৷ এ বার কিন্তু তিনিও সংক্রমিত হয়ে পড়বেন৷ তাই নোংরা হাত চোখে দেওয়াই যাবে না৷ যাঁরা চশমা পরেন, তাঁরা কম আক্রান্ত হচ্ছেন৷ কারণ তাঁরা চট করে চোখে হাত দেন না৷
মৃন্ময় দাস, চক্ষু বিশেষজ্ঞ, দিশা আই হাসপাতাল
বাড়িতে যদি কারওর হয়, বাকিরা কী কী সাবধানতা নেবেন?
সবার আগে বালিশ বিছানা আলাদা করে ফেলুন৷ তোয়ালে, গামছা রোজ সাবান দিয়ে কেচে পরিষ্কার রাখুন৷ বালিশ, বিছানা, গামছা, তোয়ালে আলাদা করে রাখলেই অর্ধেক কাজ এগিয়ে রাখবেন৷
বাচ্চার যদি কনজাংটিভাইটিস হয়, স্কুলে পাঠানো যাবে না তো?
একদম না৷ যত দিন না পর্যন্ত চোখের লাল ভাব সম্পূর্ণ কাটছে, তত দিন পর্যন্ত স্কুলে পাঠাবেন না৷ এ বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ করতে হবে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও৷ খুব বেশি হলে ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগবে সম্পূর্ণ নিরাময়ে৷ এই সময় বাড়িতেও পড়াশোনা নিয়ে চাপ না দেওয়াই ভাল৷ কারণ একটানা বইয়ের দিকে তাকাতে, মনোনিবেশ করতে এ সময় কষ্ট হয়৷ তাই চোখকে বিশ্রাম দেওয়াই বাঞ্ছনীয়৷
কনজাংটিভাইটিস হলে এর চিকিৎসা কী?
কনজাংটিভাইটিসের জন্য যে ভাইরাস দায়ী, সেই অ্যাডিনো ভাইরাসের কিন্তু কোনও অ্যান্টি ভাইরাল নেই৷ এই ধরনের অসুখ নিজের থেকেই সেরে যায়৷ আমাদের কাছে এলে উপসর্গ দেখে লুব্রিকেটিং ড্রপ দিই৷ ঘণ্টায় ঘণ্টায় দিতে বলি৷ এটাই মূল ওষুধ৷
কিন্তু কনজাংটিভাইটিস হলেই তো আর আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই না৷ কী করে বুঝব এ বার চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে?
যদি উপসর্গ অসহ্যকর হয়ে ওঠে, যে কোনওভাবেই থাকা যাচ্ছে না, তাহলে যেতে হবে ডাক্তারের কাছে৷ যদি দেখা যায় উপসর্গ ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে, চোখ ক্রমশ ফুলে উঠছে তাহলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে৷ যদি দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতেই হবে৷ নিজে থেকে যা খুশি ড্রপ দেওয়া, ওষুধের দোকান থেকে বলে ওষুধ নেওয়া-এসব কিন্তু একদমই চলবে না৷ অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ নিলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে৷ দৃষ্টিশক্তির বড় ক্ষতি পারে৷
কনজাংটিভাইটিস হলে স্মার্টফোনও দেখা চলবে না তো?
এ সময়ে চোখকে যত বিশ্রাম দেবেন ততই ভাল৷ স্মার্টফোন, টিভির স্ক্রিন সবকিছু থেকে চোখকে দূরে রাখুন৷
তাহলে কনজাংটিভাইটিস হলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই তো?
একদম চিন্তার কিছু নেই, সেটা বলব না৷ কিছু ক্ষেত্রে বেশি সতর্কতা অবশ্যই দরকার৷ যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, ক্রনিক ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা থাকলে বা বয়স বেশি হলে প্রথমেই ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে৷
যদি কারওর চোখের কোন চিকিৎসা চলে বা কারওর যদি সদ্য ছানির জন্য অস্ত্রোপচার হয়, সেই অবস্থায় যদি কনজাংটিভাইটিস হয়, তাহলে করণীয় কী?
তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে৷ জানতে হবে সেটা আদৌ কনজাংটিভাইটিস নাকি অন্য কোনও সমস্যা৷ কারণ চোখ নানা কারণে লাল হতে পারে৷ তাই এই জটিল ও স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে প্রথম দিন থেকেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতেই হবে৷
অন্যান্য ক্ষেত্রেই বা বুঝব কী করে কনজাংটিভাইটিসই হয়েছে নাকি অন্য কোনও কারণে চোখ লাল হয়েছে?
অন্য কারণ বলতে অ্যালার্জির কারণে চোখ লাল হতে পারে৷ সেক্ষেত্রে কিন্তু চোখ চুলকোবে৷ এছাড়াও উপসর্গে পার্থক্য থাকবেই৷ তাই নিয়ম হল উপসর্গের প্রথম থেকেই ডাক্তার দেখিয়ে রোগ সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া৷
অনেককেই দেখেছি কনজাংটিভাইটিস হলে সানগ্লাস পরে বেরিয়ে পড়েন৷ এটা কি ঠিক?
একদমই ঠিক নয়৷ কারণ বাইরে বার হলে সংক্রমণ ছড়াবেই৷ এ সময় গণপরিবহণ ব্যবহার করা যাবে না৷ আমি তো বলব সংক্রামক কনজাংটিভাইটিস হলে বাড়িতে থাকুন৷ কাজের জায়গা, নিমন্ত্রণবাড়িতে যাবেন না৷ আপনার চোখেরও বিশ্রাম হবে৷ আপনার থেকে বাকিদের মধ্যেও অসুখ ছড়াবে না৷
এই অসুখের হোম রেমেডি নিয়ে যদি একটু বলেন…
অনেকেই চোখে খুব জলের ঝাপটা দেন৷ আমি বলব, অত বেশি জলের ঝাপটা দেবেন না৷ বার বার চোখে জল দেওয়ার দরকার নেই৷ বরং সকালে রাতে মিলিয়ে দিনে অন্তত দু’বার চোখ মুছে নিন৷ প্রথমে সাবান দিয়ে হাত ভাল করে ধুয়ে নিন৷ তার পর গরমজলে তুলো ফুটিয়ে সেটা ঠান্ডা করে বাইরে থেকে আলতো হাতে চোখ মুছে নিন৷ এতেই সবথেকে ভাল কাজ হবে৷ সেইসঙ্গে চাইলে কোল্ড কম্প্রেসও করতে পারেন৷