ঠিক সেরকমই পার্ক বা বনের মতো জায়গাকে বলা হয়ে থাকে গ্রিন স্পেস। এই সব সবুজ স্থানের চেয়ে নীল স্থানগুলো কিন্তু আমাদের ইন্দ্রিয়কে বেশি উদ্দীপিত করে তোলে- আছড়ে পড়া তরঙ্গ, জলে আলোর ঝিকিমিকি প্রতিফলন অথবা শীতল জলের স্পর্শের অনুভূতির কথা ভাবলেই তা বোঝা যাবে।
advertisement
নীল স্থান কী?
সুতরাং, নীল স্থান হল জলকেন্দ্রিক যে কোনও পরিবেশ, তা সে প্রাকৃতিক হোক বা মনুষ্যসৃষ্ট। এর মধ্যে রয়েছে সমুদ্র, নদী, হ্রদ, পুকুর, খাল, এমনকি কৃত্রিম ঝর্ণাও, কেন না জলই তার প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং এই ধরনের ঝর্ণা কৃত্রিম হলেও ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপিত করে থাকে।
২০২০ সালে প্রকাশিত এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ-এ প্রকাশিত একটি পর্যালোচনা (এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের দ্বারা) ব্যাখ্যা করে যে এই স্থানগুলি অনন্য অভিজ্ঞতা প্রদান করে, যেমন তরঙ্গের শব্দ শোনা বা স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধ নেওয়া, যা সবুজ স্থান থেকে আলাদা। শহুরে খাল বা জলের ফোয়ারাগুলিও নীল স্থান হতে পারে যদি সেগুলো পরিষ্কার, নিরাপদ এবং সংবেদনশীলতায় সমৃদ্ধ হয়।
ভূগোলবিদ ক্যাথেরিন কেলি তাঁর ২০২১ সালের বই ‘ব্লু স্পেসেস: হাউ অ্যান্ড হোয়াই ওয়াটার ক্যান মেক ইউ ফিল বেটার’-এ এগুলোকে থেরাপিউটিক ল্যান্ডস্কেপ বলে অভিহিত করেছেন।
কেলি আয়ারল্যান্ডের মায়োর পাথুরে তীরে প্রায় সাত বছর কাটিয়েছেন, যেখানে তিনি নিয়মিত সমুদ্রে সাঁতার কাটতেন তাঁর মাকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে। “আমি সমুদ্রে ডুব দিলাম এবং সেটি আমার মধ্যে ঢুকে গেল,” তিনি বলেছিলেন। “আপনি এতে রেগে যেতে পারেন, অথবা আপনি এতে শান্তও হতে পারেন,” ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুসারে কেলি এ কথা বলেছিলেন।
তার মতে, জলের পরিবেশ আমাদের প্রশান্তি দিতে পারে অথবা শক্তি যোগাতে পারে, এটাই তাদের বিশেষ করে তোলে। স্রোতময় সমুদ্র হোক বা স্থির পুকুর, নীল স্থান আমাদের দৃষ্টি, শব্দ এবং স্পর্শের মাধ্যমে উপভোগ্যতাকে আমন্ত্রণ জানায়।
ব্লু হেল্থ কী?
নীল স্থানগুলো কেবল দেখতেই সুন্দর নয়; এগুলো আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যকেও সমর্থন করে, মেজাজ উন্নত করে এবং অন্যদের সঙ্গে আরও সংযুক্ত বোধ করতে সহায়তা করে, এই সামগ্রিক ভাল থাকাকেই ব্লু হেল্থ বা নীল স্বাস্থ্য বলা হয়।
২০২০ সালের পরিবেশগত গবেষণা পর্যালোচনা অনুসারে, নীল স্বাস্থ্য মানুষের সুস্থতায় জলভিত্তিক পরিবেশের ইতিবাচক প্রভাবকে অন্তর্ভুক্ত করে, যার মধ্যে রয়েছে চাপ হ্রাস, উন্নত শারীরিক সুস্থতা এবং শক্তিশালী সামাজিক সংযোগ।
এই ধারণাটি তুলে ধরে যে কীভাবে জলের অনন্য সংবেদনশীল গুণাবলী, এর শব্দ, নড়াচড়া এবং স্পর্শকাতর প্রকৃতি শরীরকে বিশ্রাম দিতে পারে, শারীরিক কার্যকলাপকে উৎসাহিত করতে পারে এবং সামাজিক মেলামেশাকে উৎসাহিত করতে পারে।
নীল স্থানের কাছাকাছি তাই থাকলে স্বাস্থ্যে সামগ্রিক উন্নতি অনুভব করা যায়, যা পরিবেশগত এবং জনস্বাস্থ্য গবেষণায় নীল স্বাস্থ্যকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
শারীরিক স্বাস্থ্য
নীল স্থানগুলো স্বাভাবিকভাবেই শারীরিক কার্যকলাপকে উৎসাহিত করে, সেটা নদীর ধারে হাঁটা, হ্রদে সাঁতার কাটা, অথবা খালের মধ্য দিয়ে নৌকোর প্যাডেল চালানো যাই হোক না কেন! এই কার্যকলাপগুলো হৃদপিণ্ড ভাল রাখতে সাহায্য করে, মেজাজ উন্নত করে এবং আপনার চিন্তাভাবনাকে সুতীক্ষ্ণ করে।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এ ২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে পার্ক বা জিমের তুলনায় নীল জায়গায় মানুষ বেশি সময় নিয়ে ব্যায়াম করে। কেন? কারণ জলের শান্ত প্রভাব আমাদের শারীরিক সক্রিয়তাকে প্রভাবিত করে। তাই, আমরা নিজেদের অজান্তেই আরও বেশি নড়াচড়া করি।
নীল স্থানগুলো আশেপাশের পরিবেশকেও সুন্দর রাখে। ২০২০ সালের পরিবেশগত গবেষণা পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে জল শব্দ দূষণ কমাতে পারে, বাতাসকে ঠান্ডা করতে পারে এবং দূষণের ক্ষতিকারক কণাগুলিকে ফিল্টার করতে পারে- বিশেষ করে শহরগুলিতে। এই ছোট পরিবেশগত পরিবর্তনগুলোও আমরা কতটা স্বাচ্ছন্দ্য এবং স্বাস্থ্যকর বোধ করি তার উপর একটি বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য
ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে অনেকেরই মন শান্ত হয়ে যায়। সায়েন্টিফিক রিপোর্টস-এ ২০২১ সালের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে উপকূলের কাছাকাছি বসবাস মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির সঙ্গে সম্পর্কিত, এখানে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং মানসিক চাপের হার কম। আয় এবং জীবনযাত্রার মতো বিষয়গুলো ভূমিকা পালন করলেও জল স্পষ্টতই একটি শান্ত অথচ প্রাসঙ্গিক প্রভাব ফেলে।
এটি মনোযোগ পুনরুদ্ধার নামের একটি ধারণার সঙ্গেও সম্পর্কিত, যা ২০২৪ সালের জার্নাল অফ ইমেজিং পেপারে আলোচনা করা হয়েছে। মূলত, জলের মৃদু নড়াচড়া, যেমন ঢেউ বা প্রবাহিত স্রোত, এক ধরনের শান্ত মুগ্ধতা তৈরি করে।
এটি আমাদের মস্তিষ্ককে চাপে না ফেলেই মনোযোগ আকর্ষণ করে, আমাদের মানসিকভাবে পুনরায় সুসংহত এবং রিচার্জড হতে সাহায্য করে।
প্রকৃতপক্ষে, ২০২৫ সালের নেচার কমিউনিকেশনস-এর একটি গবেষণা বিষয়টিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ভার্চুয়াল হ্রদের দৃশ্যের সংস্পর্শে আসা অংশগ্রহণকারীরা হালকা বৈদ্যুতিক শক গ্রহণের সময় কম ব্যথা অনুভব করেছিলেন এবং শহুরে পরিবেশ দেখার সময়ে তাঁদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ কম ছিল। স্পষ্ট সিদ্ধান্ত এই যে জলের দৃশ্য এবং শব্দও চাপ এবং অস্বস্তি কমাতে পারে, এমনকি সিমুলেটেড সেটিংসেও।
নীল স্থানগুলো বিস্ময়ের মতো ইতিবাচক আবেগকেও জাগিয়ে তোলে। বিশাল হ্রদ বা জলপ্রপাতের দিকে তাকালে দৈনন্দিন উদ্বেগ থেকে মনোযোগ বড় কিছুতে সরে যায়। জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল সাইকোলজিতে ২০১৮ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে এই বিস্ময় মানসিক চাপ কমাতে এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতে সাহায্য করে।
আরও ভাল ফল? জল স্মৃতিও জাগাতে পারে। গ্রীষ্মের সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণ বা হ্রদের ধারে পারিবারিক পিকনিকের কথা ভাবলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়, এই সুখের স্মৃতিগুলো আমাদের দ্রুত আবেগগতভাবে উজ্জীবিত করতে পারে, যেমনটা সায়েন্টিফিক রিপোর্টস ২০২১ গবেষণায় উল্লেখও করা হয়েছে।
সামাজিক স্বাস্থ্য
নীল স্থানগুলো কেবল প্রশান্তিদায়ক নয়, এগুলো সামাজিক বন্ধনের জন্যও দুর্দান্ত। পুকুরের ধারে পিকনিক হোক বা বন্ধুদের সঙ্গে সমুদ্র সৈকতে ছুটির দিন, এই স্থানগুলো মানুষকে একত্রিত হতে, কথা বলতে এবং আরাম করতে উৎসাহিত করে।
২০২৩ সালে হেলথ অ্যান্ড প্লেসে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে যাঁরা অন্যদের সঙ্গে নীল জায়গায় যান তাঁরা আরও শক্তিশালী সামাজিক সংযোগ অনুভব করেন, যা মানসিক স্বাস্থ্য এবং স্থিতিস্থাপকতার জন্য অত্যাবশ্যক। সামগ্রিকভাবে, জল মানুষকে একত্রিত করে।
নিজের জীবনে নীল স্থান কীভাবে যুক্ত করা যায়
এর সুবিধাগুলো অনুভব করার জন্য সমুদ্র সৈকত বা নদীর কাছাকাছি বাস করার দরকার নেই। গবেষণা অনুসারে কীভাবে জীবনে আরও নীল জায়গা নিয়ে আসা যায় তা এখানে দেওয়া হল:
১. কাছাকাছি জল খুঁজে নিতে হবে
নদী বা হ্রদ না পেলেও অন্তত শহরের পরিষ্কার খালগুলো মাঝে মাঝে দেখা উচিত। ২০২০ সালের পরিবেশগত গবেষণা পর্যালোচনা বলছে যে ছোট, সুসজ্জিত জলাশয়ও মন শান্ত করতে সাহায্য করতে পারে। প্রতি মাসে একটি নতুন নীল স্থান খোঁজার অভ্যাস করলে এটি সব কিছুকেই তাজা এবং মজাদার করে তুলবে।
Male Breast Cancer Symptoms: ছেলেদেরও হয় স্তন ক্যানসার! লক্ষণ কী কী? জানুন কখন মারণ রোগ বাসা বেঁধেছে আপনার শরীরে
২. নীল জায়গায় সপ্তাহে দুই ঘণ্টা সময় কাটানো
২০১৯ সালের সায়েন্টিফিক রিপোর্টস-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রকৃতিতে সপ্তাহে প্রায় দুই ঘণ্টা (নীল বা সবুজ) কাটানো স্বাস্থ্যের উন্নতির সঙ্গে সম্পর্কিত। জলের ধারে রোজ ৩০ মিনিটের হাঁটা অথবা সপ্তাহান্তে দীর্ঘ ভ্রমণ, যে ভাবে খুশি তা করা যেতে পারে।
৩. ইন্দ্রিয় সচেতনতা
জলের ধারে শুধু গেলেই হবে না, যা চোখে পড়ছে তা ভালভাবে দেখা, চারপাশের সব কিছু শোনা এবং অনুভব করা গুরুত্বপূর্ণ- জলের শব্দ, মাটির গন্ধ, আলোর প্রতিফলনের উপর মনোযোগ দেওয়া দরকার। জার্নাল অফ ইমেজিং (২০২৪) উল্লেখ করেছে যে এই ধরনের মননশীলতা আরাম করতে এবং অন্যমনস্ক না হতে সাহায্য করে। মেজাজ উন্নত করার জন্য সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময়ে জল দেখার চেষ্টা করা উচিত।
৪. জলে নামা
সাঁতার কাটা বা এমনকি শুধু জলে পা ডুবিয়ে থাকাও উপকারী। ২০১৫ সালে এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে জলের সঙ্গে শারীরিক সংস্পর্শ প্রশান্তি বা আনন্দের মতো মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
নীল স্থান কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বর্তমানের কোলাহলপূর্ণ, দ্রুতগতির পৃথিবীতে নীল স্থানগুলো ঠিক যেন একটি প্রাকৃতিক রিসেট স্পট। এগুলি আমাদের ইন্দ্রিয়কে সক্রিয় করে, মেজাজ উন্নত করে, স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং মানুষকে একত্রিত করে।
প্রাকৃতিক জলাশয় হোক বা শহরের ছোট ঝর্ণা, এই জায়গাগুলো নিমেষে শান্তি প্রদান করে। অতএব, ইচ্ছাকৃতভাবেই জীবনে নীল স্থান যোগ করলে, এমনকি ভার্চুয়াল হলেও মন এবং শরীরকে নিরাময়ের একটি শক্তিশালী উপায় প্রদান করা যায়।