ছাত্রাবস্থা থেকেই সংঘের ছাত্র সংগঠন এবিভিপির সক্রিয় কর্মী সুকান্ত। মা নিবেদিতা চৌধুরী মজুমদার। নিবেদিতাদেবীর উপর সংঘের প্রভাব ছিল। তিনি সংঘের অনুষ্ঠানেও যেতেন। যদিও, সংঘের সদস্য ছিলেন না। ফলে, সুকান্তর রাজনীতিতে হাতেখড়ি বহু আগেই। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মালদহের গৌড়বঙ্গ কলেজের সহকারী অধ্যাপক। আচমকাই, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বালুরঘাট থেকে তাঁকে প্রার্থী করল দল। তৃণমূলের বিরুদ্ধে জয়ীও হলেন তিনি।
advertisement
অধ্যাপকের জীবনে সাময়িক ছেদ টেনে দিল্লির সংসদে গেলেন সুকান্ত। এ পর্যন্ত ঠিকঠাকই চলছিল সুকান্ত বা তাঁর পরিবারের কাছে। কিন্তু, দিল্লি থেকে গত ১৯ সেপ্টেম্বরের ফোনটা সুকান্ত'র সব হিসেব-নিকেশকে গুলিয়ে দিল। ইঙ্গিত ছিল আগেই। দিল্লি থেকে জানানো হল, কালই তাকে রাজ্য বিজেপির সভাপতির দায়িত্ব নিতে হবে। পত্রপাঠ, ট্রেন ধরে সাতসকালে কলকাতা। যাকে বলে একেবারে গরম চাটু থেকে ফুটন্ত তেলের কড়াইতে পড়া। দায়িত্ব হাতে পেয়েই সুকান্ত বুঝতে পারলেন, 'রাজ্যাভিষেকের' আগেই তাঁর সামনে হাজির "অশ্বমেধের ঘোড়া"। ভবানীপুরের অসম লড়াইয়ে সেই ঘোড়াকে বাঁধার সাহস দেখাতে হবে তাঁকে। নিশানা স্থির করে দিয়েই তাঁকে পাঠিয়েছে দিল্লি। দায়িত্ব দেওয়ার চিঠি পাঠিয়ে, সুকান্তকে ফোন করে সর্বভারতীয় সম্পাদক (সংগঠন) বি এল সন্তোষ, সুকান্তকে বলেছিলেন, "রাজ্যের দায়িত্ব নিতে হবে। লড়াই করাই এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।"
আরও পড়ুন: প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে ভবানীপুরে সম্বিত পাত্র, হঠাৎ এক গান আর স্লোগানেই ছন্দপতন! তারপর?
ফলে, শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ মেনে লড়াই শুরুর প্রথম রণক্ষেত্র হিসাবে সুকান্তর কাছে ভবানীপুরের বিকল্প কিছু ছিল না৷ আর, "দ্রোণাচার্য" সন্তোষের নির্দেশ কার্যকর করতে সুকান্ত সচেতন ভাবেই নিশানা করলেন মমতা হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রিটকে। মরদেহ নিয়ে আচমকা রুট বদল করে মমতার ডেরায় ঢুকে পড়া, পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে জড়ানো, প্রতিবাদে রাস্তায় বসে পড়া, শেষমেশ পুলিশের হাতে 'চ্যাংদোলা' হয়ে শুরুর দিন থেকেই সংঘর্ষের বার্তা দিলেন সুকান্ত? যদিও, এই সব কিছুর মধ্যেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অতীতের আয়নায় বিরোধী নেত্রী মমতাকেই দেখছেন।
তবে, সুকান্তর রাজনৈতিক জীবনে এটা শুরুর শুরু। আর, এই সবই রাজনীতির কারবারীদের বিষয়। তা নিয়ে আর পাঁচ জন মা বা রাজনৈতিক পরিবারের মতোই বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্তর মা বা তাঁর পরিবারের আলাদা করে কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। বরং সুদূর বালুরঘাটের বাড়ি থেকে টিভির পর্দায় ছেলের এই 'সংঘর্ষ' করা দেখে তাঁরা বরং আশঙ্কিত। সুকান্ত মজুমদার ছাত্রাবস্থা থেকে রাজনীতি করলেও, সেই রাজনীতি কখনো শিক্ষাঙ্গনের গণ্ডি পেরোয়নি। পেরোয়নি লক্ষ্মণরেখাও। ২০১৯-এর ভোটে প্রার্থী হওয়ার পর সভা, সমিতিতে মিতভাষী ছেলের রাজনৈতিক ভাষণ টিভির পর্দায় দেখার মধ্যে ছিল অন্য এক শিহরণ। সংসদের অলিন্দে কিংবা প্রধানমন্ত্রীর দফতর গিয়ে মাঝে মধ্যে এক ফ্রেমে ধরা পড়া ছবিও এতদিন বাড়ির দেওয়ালে বেশ মানানসই ছিল সুকান্তর মা ও তার পরিবারের কাছে।
আরও পড়ুন: জটিলতা আরও বাড়ল? ভবানীপুরের ভোট নিয়ে কমিশনের উপর চরম ক্ষুব্ধ হাইকোর্ট! যা হল..
কিন্তু, আচমকা এই পুলিশের হাতে 'চ্যাংদোলা' হওয়ার ছবি নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে বালুরঘাটে নিভৃতে থাকা সুকান্তর মা ও তাঁর পরিবারকে। একদিকে, ছেলে সুকান্তর আগামী রাজনৈতিক জীবন নিয়ে একরাশ উদ্বেগ আর অন্যদিকে নতুন দায়িত্ব পাওয়ার সুবাদে পরিবারের সঙ্গে প্রতিদিনের যোগাযোগে টান পড়া, সব মিলিয়ে ছেলের বড় দায়িত্ব পাওয়ার পরেও কেমন যেন দুঃখী হয়ে রয়েছেন সুকান্তর মা ও পরিবারের বাকি সদস্যরা। এমনিতেই সাংসদ হওয়ার জন্য বাড়ি ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে মাঝে মধ্যেই দিল্লিতে কাটাতে হচ্ছিল সুকান্তকে। তা নিয়ে অর্ধাঙ্গিনীর মনে অভিমান ছিলই, বিশেষত ছোট মেয়ে শ্রীময়ীর। সুকান্ত নিজেই স্বীকার করেছেন, রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার খবরে সবচেয়ে অখুশী তাঁর মেয়ে ও পরিবার। কারণ, দল ও সংগঠনের স্বার্থে তাঁকে এবার অনেক বেশি সময় বালুরঘাটে নিজের পরিবারকে ছেড়ে ৪০০ কিলোমিটার দূরে কলকাতায় পড়ে থাকতে হবে। ফলে, বাবাকে কাছে না পাওয়ার দুঃখ তো থাকবেই মেয়ের। একই ভাবে নিজের ছেলেকে একান্তে পাওয়ার সুযোগও কমবে মায়ের। তবু, কথায় বলে, কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতেও হয়, হয়ত সেই লক্ষ্যেই এই ত্যাগস্বীকার। আগামী দিনই বলবে, সেই লক্ষ্যে কতটা এগোতে পারলেন বিজেপির নতুন রাজ্য সভাপতি।
