বসিরহাট মহকুমার দুই নেতা৷ বাবু মাস্টার ও শেখ সাজাহান৷ এঁদের নিয়ে বরাবরই রয়েছে বিতর্ক। বাম আমলে সিপিএমের ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তাঁদের বিরুদ্ধে আঙুল তুলত তৃণমূল। এখন তৃণমূল ঘনিষ্ঠতার কারণে একই অভিযোগ করে থাকেন বিরোধীরা।
সন্দেশখালিতে বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যুর পরও তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। বাবু মাস্টারের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব বাড়লেও। প্রবল প্রতাপশালী হয়ে ওঠে শেখ শাহজাহান। বর্তমানে তিনি জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ।
advertisement
আরও পড়ুন: মাথা ফাটল ২ ইডি আধিকারিকের! সন্দেশখালির ঘটনায় NIA তদন্ত দাবি, বিস্ফোরক শুভেন্দু
২০১৯ সালে জেলার পাঁচটি লোকসভা আসনের দু’টি হাতছাড়া হওয়ায় উত্তর ২৪ পরগনায় সংগঠন সাজাতে শুরু করে তৃণমূল। জেলার পাঁচ লোকসভা আসনের দলীয় কাজকর্ম পরিচালনার ভার জেলার পাঁচ নেতার হাতে দেওয়া হয়। কিন্তু হাতছাড়া এলাকা ফিরে পেতে সেই প্রস্তুতি নিয়ে দলীয় নেতৃত্ব যে পথে এগোচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায় দলের অন্দরেই।
সেই সময় জেলার বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন তৎকালীন জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। সেই বৈঠকেই আলোচনার সময় বসিরহাটের কাজকর্মের জন্য যে কমিটি করা হয়, তাতে শাহজাহান ও বাবুমাস্টারের নাম দেখে আপত্তি ওঠে। মধ্যমগ্রামের বিধায়ক রথীন ঘোষ এই দু’জনের ভাবমূর্তি নিয়ে আপত্তি জানান। তাঁকে সমর্থন জানিয়ে এই দু’জনকে দায়িত্বে না রাখার কথা বলেন নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক। আরও দু’তিন জন বিধায়কও তখন আপত্তি জানাতে শুরু করেন।
তবে এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ, নিজের প্রভাব বজায় রাখতে বরাবরই মরিয়া শাহজাহান। তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, তিনি যখন তৃণমূলে যোগ দেন, তখন দলের সন্দেশখালি ১ ব্লক সভাপতি রঞ্জিতকুমার দাস। এক বছরের ব্যবধানে দীর্ঘদিনের তৃণমূল নেতা, শিক্ষক রঞ্জিতকে সরিয়ে ব্লক সভাপতি হয়ে যান শাহজাহান।
তারপর নিজের এলাকায় পর পর দু’বার প্রহৃত হন রঞ্জিত। সে সময়ে শাহজাহানের বিরুদ্ধে দলের নেতৃত্বের কাছে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ রঞ্জিত। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। শাহজাহান থেকে যান বহাল তবিয়তেই।
আরও অভিযোগ, গত ২০১৮ পঞ্চায়েত ভোটে সন্দেশখালি থেকে রঞ্জিতকে ভোটে দাঁড়াতেই দেয়নি শাহজাহানের দলবল। তাঁকে হিঙ্গলগঞ্জ থেকে লড়তে পাঠানো হয়। ভোটে জিতেও কোনও পদ পাননি তিনি। এ নিয়ে দলের সর্বোচ্চ মহলে গিয়েছিলেন রঞ্জিত। এলাকার বাসিন্দারা অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে বিপুল পোশাক সন্দেশখালি হয়ে কলকাতায় পাচার হয়। সেই কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও অভিযোগ রয়েছে শাহজাহানের বিরুদ্ধে।
ভেড়ির মাছ চাষই এখানকার মানুষের মূল জীবিকা। সেখানে যে চিংড়ি, ভেটকি, পার্শে মাছ চাষ হয়, তা যায় কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। ভেড়িকে ঘিরেই নানান ব্যবসা বসিরহাট মহকুমার আনাচে কানাচে। এর সবটাই নিয়ন্ত্রক এই শাহজাহান।
এলাকার লোকেরা বলে থাকেন ‘জলকর বা ঘেড়ি’। অভিযোগ, বাম আমলে এই শাহজাহান বাহিনীই জলকরে বিঘা প্রতি তোলা আদায় করত। তৃণমূল আমলে তা দাঁড়িয়েছে কাঠা প্রতি তোলার হিসাবে। এলাকার কোনও জলকর শাহজাহানের অনুমতি ছাড়া নিলাম হয় না বলে দাবি এলাকাবাসীর একাংশের। এই নিলাম প্রক্রিয়া পরিচালনা করে এই নেতার লোকেরাই। ফলে কে কোন জমি, কত দিনের জন্য ইজারা পেল, তা লেখা থাকে শাহজাহানের লোকজনের কাছেই।
শুধু মেছো ভেড়িই নয়, এলাকায় প্রচুর ইটভাটাও রয়েছে। অভিযোগ, সেখানেও তোলার বন্দোবস্ত রয়েছে শাহজাহানের। অভিযোগ, স্থানীয় কলেজের ভোটও কব্জা করে রেখেছিল শাহজাহানের বাহিনী। ভোটের দিন দু’য়েক আগে থেকে তারা কলেজের পাশে ডেরা বেঁধে ছিল। সেই দু’দিন ন্যাজাট বাজারের দোকানে দোকানে ঢুকে চাল-ডাল-মাছ-মাংস-ডিম-মিষ্টি, যা ইচ্ছা তুলে নিয়ে গিয়েছিল বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। ভোটের দিন কলেজ ঢোকার সব রাস্তায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে টহল দেয় শাহজাহানের লোকেরা। ফলে কেউ আর কলেজে যাওয়ার সাহস করেনি। দিন শেষে রাস্তার ঘুমন্ত কুকুরকে গুলি করে মেরে ভোটে জেতার উল্লাস করেছিল সেই বাহিনী। এ সবই স্থানীয় মানুষের কথা৷
তবে, বছর তিনেক আগে সন্দেশখালির ভাঙিপাড়ায় বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষে তিনজন খুন হওয়ার পরে নতুন করে চর্চায় আসে শাহজাহানের নাম। বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত এই তৃণমূল নেতা শাহজাহান।