একটা, শুধু একটা নাম যেন ধুঁকতে লাল দলটার ফুসফুসে অক্সিজেন সিলিন্ডারের মতো কাজ করে। এবারের ব্রিগেডের আগে তাই মীনাক্ষীই ছিলেন ‘ক্যাপ্টেন’। ব্রিগেডের ভিড় বলছে, ‘লোক টানতে’ ক্যাপ্টেন সফল, কিন্তু দুয়ারে চলে আসা লোকসভা ভোট! হবে তো ক্যাপ্টেন? ঘুরে দাঁড়াবে তো কোমর ভেঙে যাওয়া দলটা? ব্রিগেড ফেরত মুখগুলোতে যেন এই প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে থাকল কলকাতার শীতের বিকেলে।
advertisement
২০০৮ সালের পর ২০২৪। ১৬ বছর পর ফের ডিওয়াইএফআইয়ের ডাকে ব্রিগেড সমাবেশ। আর সেই ব্রিগেডের মুখ বাম যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। বিমান বসুর মতো নেতা যাঁকে ইতিমধ্যেই ‘ক্যাপ্টেন’ তকমা দিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে নিয়ে বাম কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকবে, এতে আর আশ্চর্যের কী! কিন্তু মীনাক্ষী যেন ম্যাজিক। তাঁর ছবি, ব্যানার, কাটআউটে ভরে গিয়েছে জেলা থেকে শহর৷ গত ৫০ দিনের ইনসাফ যাত্রা, ইনসাফ সভার হোতা ছিলেন এই মীনাক্ষীই। মধ্য তিরিশের এই মেয়েই এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বামপন্থীদের। বলছেন, বেঁচে থাকতে চাইলে আসুন লড়াইয়ে।
আরও পড়ুন: ‘ভুলে গেছি’, নজরুলের কবিতা বলতে গিয়ে থমকালেন মীনাক্ষী! কী ঘটল ব্রিগেডে?
চমকপ্রদ ভাবে, রবিবার সমাবেশের আগে ব্রিগেডের ময়দানের উদ্দেশে মীনাক্ষী রওনা দিলেন এক কর্মীর বাইকে চেপে। রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এ চিত্র বহুবার দেখে নিয়েছে রাজ্যবাসী। অর্থাৎ সমাবেশের আগেই আলোচনার নতুন রসদ তৈরি করলেন মীনাক্ষী। ‘মাস লিডার’রা কি তবে এমনই হন? সব আলো কেড়ে নেন! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গেও একসময় যার তুলনা করছিলেন বাম নেতারা, তাঁর তো এই ম্যাজিকটুকু থাকবেই! বুদ্ধদেবের পর আর কোনও বাম নেতা-নেত্রীকে ঘিরে এমন বৃত্ত তৈরি হয়েছে কি? উত্তর খুব সহজ, ‘না’!
শনিবার ডিওয়াইএফের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে গিয়ে লড়াইয়ের বার্তা নিয়ে ফিরেছেন, ব্রিগেডের মঞ্চে এমনটাই জানিয়েছেন মীনাক্ষী। পাঠ করেন সেই বার্তা, যা আদতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানের পংক্তি, ‘যেখানে ডাক পড়ে, জীবন-মরণ-ঝড়ে আমরা প্রস্তুত’। অসুস্থ বুদ্ধদেবও কি বুঝে গেলেন, পরবর্তী ক্যাপ্টেন তৈরি! কিন্তু এই ক্যাপ্টেনের পথ যে আরও কঠিন। অতলে তলিয়ে যাওয়া দলকে তুলে এনে আবার ‘প্রাসঙ্গিক’ করে তোলা, লড়াইয়ের ময়দানে বুক চিতিয়ে দাঁড় করাতে পারবেন তো মীনাক্ষী? বাংলায় কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকা একনিষ্ঠ বাম জনতা আবার কিন্তু স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।
আরও পড়ুন: সাদামাঠা পোশাক, বাইকে চড়েই ব্রিগেডে! মমতার ছবির সঙ্গে মীনাক্ষীর মিলের খোঁজ অনেকের
‘ইন্ডিয়া’ জোটের বাধ্যবাধকতা উড়িয়ে রবিবার সমানতালে তৃণমূল-বিজেপিকে নিশানা করেছেন মীনাক্ষী। বলেছেন, ”অনেক আশা নিয়ে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন, আকাশ থেকে নেমে কোনও ‘ফরিস্তা’ আমাদের ভাল করবে। কিন্তু কী হল, এখন আমাদের বাঁচার লড়াই।” জানিয়েছেন, ছোট থেকে ব্রিগেডে আসছেন। বাবার সঙ্গে। তখন অন্য দিকে হত মঞ্চ। এর পরেই চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের কথা তুলে যুব নেত্রী বলেছেন, টিভি ক্যামেরার সামনে নিজের শরীরের সব থেকে সুন্দর অংশ চুল কেটে ফেলেছেন যে শিক্ষিকা, তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে। বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘রামে’ চলে যাওয়া বাম ভোট ফিরিয়ে আনা তাঁর কাছে চ্যালেঞ্জ। মনে করিয়েছেন, সিপিএমের নিহত কর্মী আনিস খান, সুদীপ্ত গুপ্তদের কথা। সবই হল, কিন্তু ক্যাপ্টেনের বক্তৃতায় সেই ঝাঁঝ পেলেন না অনেকেই। কেউ বললেন, টানা ৫০ দিনের ইনসাফ যাত্রার ক্লান্তি। কেউ বললেন, লড়াই তো আসলে সামনে, দম রাখতে হবে তো! মীনাক্ষীর মধ্যে যে নতুন উদ্যমই দেখছেন লক্ষ জনতা।
বহুদিন পর চনমনে, থিকথিকে ভিড় দেখল ব্রিগেড। স্বপ্ন দেখছে যে ভিড়, ফিরে আসার স্বপ্ন, ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, আপনি পারবেন তো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া লাল ব্রিগেডের সামনে নতুন লক্ষ্যস্থির করতে? নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে? উত্তর কিছুটা নিজেই দিয়েছেন মীনাক্ষী, বলেছেন, ‘‘কারা বলে বামপন্থীরা শূন্য? ওঁরা বামেদের ভয় পান। আমাদের রাগ নেই। ভয় নেই।” কিন্তু জয়? জয় আসবে তো ক্যাপ্টেন?