কিন্তু কেন এই প্রশ্ন উঠছে? রেড ভলান্টিয়াররা কাজ বন্ধ করে দিলে ঠিক কতটা ক্ষতি হবে রাজ্যের মানুষের? তা বুঝতে গেলে আগে বিশদে জেনে নিতে হবে ঠিক কীভাবে কাজ করছেন এই তরুণ তুর্কীরা। নিজেদের জীবন এক প্রকার বাজি রেখেই এই রেড ভলান্টিয়াররা কাজ করছেন। করোনা (Corona) আক্রান্তের কাছে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে ওষুধ কিনে দেওয়া, অথবা যে বাড়িতে সবাই আক্রান্ত তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করে দেওয়া, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সবই অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছে এঁদের জন্য। এমনকি কিছু এলাকা নিজেরা স্যানিটাইজ পর্যন্ত করছেন তাঁরা। আর এই সাহসটা তাঁদের আদর্শেরই অংশ। বলছেন বাম যুবনেত্রী দীপ্সিতা ধর (Dipshita Dhar)। তাঁর কথায়, "এই সাহসটা আদর্শ থেকে আসে। যারা ২০১১ সাল থেকে তৃণমূল ও বিজেপির বিপরীতে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করছে তারা নিজেদের ভালো থাকার থেকেও প্রত্যেকে সমষ্টিগত ভাবে কী ভাবে ভালো থাকতে পারে সেদিকটাই দেখে।"
advertisement
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের মাত্রা সীমা ছাড়াচ্ছে প্রতিদিন। আক্রান্তের সংখ্যা রোজ নতুন রেকর্ড গড়ছে। ফলে অক্সিজেন ও হাসপাতালের বেডের (Hospital beds) হাহাকার জারি রয়েছে। এর মধ্যেও কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিয়ে যাওয়া রেড ভলান্টিয়ারদের চ্যালেঞ্জ। গোটা বাংলায় এলাকাভিত্তিতে কাজ করছেন রেড ভলান্টিয়ার্স। তাই ঠিক কতজন এই কাজে যুক্ত সেই সংখ্যা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কোনও নির্দিষ্ট কেন্দ্রও তৈরি হয়নি এর জন্য। সোশ্যাল মিডিয়াতেও ইতিমধ্য়ে ওয়ার্ড বিশেষে রেড ভলান্টিয়ারদের ফোন নম্বর মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। দীপ্সিতা বলছেন, "পুরো কাজটাই স্থানীয় ভাবে হচ্ছে। কোনও কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। প্রত্যেকটি এলাকায় যেমন আগের বার কোভিডের সময়ে রেড ভলান্টিয়াররা তৈরি হয়েছিল, সেভাবেই কাজ হচ্ছে। নির্বাচনের পর বিধানসভা কেন্দ্রের হিসেবে কো-অর্ডিনেশন তৈরি করেছি। যেমন বালিতে দুটি এলাকা রয়েছে। একটি বালি-বেলুড়, অন্যটি লিলুয়া।"
করোনা দ্বিতীয় ঢেউতে অন্যতম সমস্যা অক্সিজেন সঙ্কট। বিশেষ করে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই সংক্রমণ উর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে এবং পাশাপাশি অক্সিজেন ও হাসপাতালে বেডের ঘাটতি দেখা যায়। এই সময় থেকেই রেড ভলান্টিয়াররা মাঠে নেমে কাজ শুরু করেন। রেড ভলান্টিয়ার্স -এই নামের সঙ্গে পরিচিতি সদ্য হলেও, করোনার প্রথম থেকেই এরা কাজ শুরু করেছিলেন। যাদবপুর এলাকার রেড ভলান্টিয়ার শুভঙ্কর দাস বলছেন, "প্রথম ঢেউয়ের সময়েও রেড ভলান্টিয়ারস ছিল। তখন অক্সিজেন, ওষুধের জোগানের ব্যাপার ছিল না। ভ্যানে করে খাবার দেওয়া থেকে শুরু হয়েছিল, যা পরে শ্রমজীবী ক্যান্টিনে রূপান্তরিত হল। মূল কাজ তখন থেকেই শুরু। এর পরে বাড়িতে বাড়িতে মাস্ক পৌঁছে দেওয়া, খাবারের ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং স্যানিটাইজার তৈরি করে দেওয়া ইত্যাদি।"
কিন্তু যেহেতু দ্বিতীয় ঢেউতে সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বেশি তাই অক্সিজেনের চাহিদাও বেশি। এক্ষেত্রে একদল রেড ভলান্টিয়ার যেমন মাঠে নেমে কাজ করছেন। আবার আর একদল সোশ্যাল মিডিয়ায় লিড শেয়ার করা এবং হাসপাতাল ও অক্সিজেনের যোগাযোগ নম্বর ভেরিফাই করার কাজ করছেন। শুভঙ্কর বলছেন, "অক্সিজেনের সাপ্লায়ার ও প্রোভাইডারদের ডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এক একটি এলাকায় রেড ভলান্টিয়ারদের মধ্যে ৫-৬ জনের কাজই হল প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় অন্তর অক্সিজেনের লিডে ফোন করে নম্বর ভেরিফাই করা এবং দেখা এরা সত্যিই অক্সিজেন সরবরাহ করে কি না। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে ৫০-৬০টি নম্বরের মধ্যে ১৮-২০ টা নম্বর ভেরিফায়েড হচ্ছে।" শুধু অক্সিজেনের জোগান নয়। ডোর টু ডোর RT-PCR টেস্টও দায়িত্ব নিয়ে করাচ্ছেন তাঁরা। এক্ষেত্রেও ডেটা সংগ্রহ করে ভেরিফাই করতে হচ্ছে।
এই ভেরিফায়েড নম্বরে সাহায্য পাচ্ছেন অনেকেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় রেড ভলান্টিয়ার্সদের গ্রুপে চোখ রাখলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। অতএব এহেন রেড ভলান্টিয়াররা কাজ বন্ধ করলে দিলে রাজ্যের সাধারণ মানুষকে যে কোভিড পরিস্থিতিতে সমস্যায় পড়তে হবে তা বলাই বাহুল্য। বর্ধমান শহরের রেড ভলান্টিয়ার তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, "বিভিন্ন জায়গায় রেড ভলান্টিয়াররা আক্রান্ত হচ্ছেন। বর্ধমান শহরেও যারা রেড ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করছেন তাঁদের বাড়িতেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা বদ্ধপরিকর যে আমরা কাজ বন্ধ করব না। রেড ভলান্টিয়ারদের প্রথম যে মিটিং হয়েছিল তাতে প্রথম সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছিল, আমাদের উপর আক্রমণ আসবে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মানুষের জন্য আমরা কাজ করে যাব। আজ সকালেও মিটিং-এ আমরা ঠিক করেছি, কাজ বন্ধ করব না। আমাদের মূল লক্ষ্য কোভিড পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করা।"
তিতাস জানান, রাজনৈতিক দল নির্বেশেষে তাঁরা মানুষকে সাহায্য করছেন এবং আগামীতেও করবেন। কিন্তু আক্রান্ত হলে প্রশাসন সঠিক ব্যবস্থা নেবে ও নিরাপত্তা দেবে বলে আশা রাখছেন তিনি। এই প্রসঙ্গে বাম যুবনেত্রী বলছেন, "বিভিন্ন নোংরামো করা হচ্ছে। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা শাসকদল। এটা নির্বাচনের আগে হয়নি একটাও। এমনও হয়েছে তৃণমূল বাড়িতে আমরা অক্সিজেন লাগিয়ে দিয়ে এসেছি। নির্বাচনের আগে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ফলাফলের পরে চিত্রগুলি বদলাচ্ছে। তবে আমরা আগের মতোই কাজ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা তো সেবা করার জন্য জীবনগুলোকে শেষ করে দিতে পারি না। তাই যে জায়গায় এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কাজ বিঘ্নিত হয়েছে। কিন্তু কাজ পুরোপুরি বন্ধ করিনি। আক্রমণ প্রতিহত করেই কাজ চলছে। তবে আগে যে মসৃণতা ছিল কাজে তা ব্যাহত হয়েছে কোনও কোনও জায়গায়। আর তাই যেখানেই যাচ্ছি আমরা বেশি লোক নিয়ে যাচ্ছি। যে যে ফোন নম্বর এর পিছনে দায়ী সেগুলিকে সাইবার ক্রাইমে আমরা দিয়েছি ও ফলাফলও পেয়েছি। তবে কাজের রাস্তা এখনও বন্ধুর।"
শুধু কলকাতা বা কলকাতা সংলগ্ন অঞ্চল নয়। রাজ্যের প্রতিটি জেলাতে এলাকা ভাগ করে নিয়ে কাজ করছেন রেড ভলান্টিয়াররা। উত্তরবঙ্গের রেড ভলান্টিয়ারদের ফেসবুকে একটি পৃথক গ্রুপও রয়েছে। জলপাইগুড়ির রেড ভলান্টিয়ার সূরয দাশ জানাচ্ছেন, তাঁরা জোর কদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বিভিন্ন এলাকায় ঘটলেও কাজ তাঁরা বন্ধ করবেন না। কারণ তাঁদের মূল উদ্দেশ্যই মানুষকে কোভিড মোকাবিলায় সাহায্য করা। যদিও তাঁর এলাকায় কোনও রেড ভলান্টিয়ারের উপর আক্রমণ বা হেনস্থার ঘটনা ঘটেনি বলে তিনি জানিয়েছেন।
এছাড়াও অন্যান্য কিছু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে রেড ভলান্টিয়ারদেরও। একই সঙ্গে একাধিক জায়গা থেকে অক্সিজেন প্রয়োজনের কথা জানাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু সেই পরিমাণ রিসোর্স সেই মুহূর্তে না থাকায় একটি সিদ্ধান্তে আসতে হচ্ছে তাঁদের। দীপ্সিতা বলছেন, "প্রায়ই এরকম পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অক্সিজেনের ক্ষেত্রে সুবিধা হচ্ছে অক্সিমিটার দিয়ে চেক করে বোঝা যায় কার কী অবস্থা। তাই যাঁরা চাইছেন তাঁদের থেকে আমরা অক্সিজেনের মাত্রা জানতে চাইছি। অথবা কাছাকাছি হলে আমরা নিজেরাই যাচ্ছি। যেখানে যার সবচেয়ে বেশি জরুরি বা যার সবচেয়ে কম স্যাচুরেশন তাকেই আমরা আগে রাখছি। চেষ্টা করছি সকলকে দেওয়ার। কিন্তু রিসোর্স সীমিত। তাই এভাবেই করতে হচ্ছে।"
আট দফার নির্বাচনের মাঝামাঝি সময় থেকেই রাজ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আর সেই সময় থেকেই মানুষ রেড ভলান্টিয়ার্সদের সঙ্গে মানুষের পরিচয় আরও বেশি। আর তাই বিভিন্ন মহলেই প্রশ্ন উঠছে, নির্বাচনের আগে থেকেই কাজ শুরু করলে কি ব্যালট বক্সে তা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করত? বাম নেত্রী বলছেন, "আমরা আগেও ছিলাম। হয়তো পরিষেবা প্রদানকারী হিসেবে ততটাও প্রকাশ্যে আসিনি। কিন্তু আমরা আমফানে মাঠে নেমে কাজ করেছি, এতগুলি শ্রমজীবী ক্যান্টিন করেছি। আর তাছাড়া আমরা এগুলি ভোট পাওয়ার জন্য করিনি। এটা জনসংযোগ বাড়াতে পারে মাত্র। ভোট পাওয়ার জন্য রাজনীতির প্রয়োজন, আন্দোলনের প্রয়োজন। যে আন্দোলন মানুষ চেয়েছিল সেই জায়গায় হয়তো আমরা পৌঁছতে পারিনি। তবে এবারের নির্বাচন মেরুকরণের উপর ভিত্তি করে হয়েছে। মানুষ তাই বিজেপি-কে আটকাতে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। তাই আমরা আমাদের কাজ ভোটের নম্বরের সঙ্গে তুলনা করছি না।"