রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য দু দফায় ২ টি নাম পাঠিয়েছিল নবান্ন। কিন্তু, তাতেও ‘সন্তুষ্ট’ না হয়ে তৃতীয় নাম চেয়ে নবান্নকে নোট পাঠিয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। এই আবহে আজ দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ প্রশ্নে রাজ্যপাল বলেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এরপরেই, আজ বিকেলে নবান্নে রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে কড়া মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন, নিয়ম মেনেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ব্যাপারে রাজ্যপালের কাছে অনুমোদন চেয়ে নাম পাঠিয়েছে রাজ্য সরকার। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে নাম নিয়ে রাজ্যপাল যেভাবে তার পছন্দকে নবান্নের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন, সে বিষয়ে রাজ্য সরকার যে আর কোন নরম মনোভাব দেখাতে চায় না, সেই বার্তাও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
advertisement
প্রসঙ্গ : রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ
“সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ” — রাজ্যপাল
“রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য আমরা সময়মত নাম পাঠিয়েছি। জানি না কেন এমন হচ্ছে। আমি মাথা নিচু করছি না। অতীতে কখনো এমন হয় নি। আশা করি, শুভবুদ্ধির উদয় হবে। ” —মুখ্যমন্ত্রী
গত রবিবার, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সৌরভ দাসের মেয়াদ শেষ হয়েছে। হিসেবমত, তারপরেই সৌরভের থেকে নতুন কমিশনারের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে কাজ শুরু করার কথা। কিন্তু, ৪৮ ঘন্টা পরেও কমিশনার পদে নিয়োগের ফাইলে অনুমোদন দেন নি রাজ্যপাল। ফলে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে একপ্রকার ‘অচলাবস্থা’ তৈরি হয়েছে কমিশনে।
গত ১৮ মে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীবা সিনহার নাম মনোনীত করে সংশ্লিষ্ঠ ফাইল অনুমোদনের জন্য রাজ্যপালের কাছে পাঠায় নবান্ন। কিন্তু, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে মাত্র একজনের নাম কেন প্রস্তাব করা হয়েছে, এই প্রশ্ন তুলে নবান্নকে ফাইল ফেরৎ পাঠায় রাজভবন। নবান্ন সূত্রে জানা গেছে, এরপরেই রাজ্যপালের মনোভাব আঁচ করে পঞ্চায়েতের আগে নতুন করে কোন জটিলতা যাতে তৈরি না হয়, সে কারনে রাজীবা সিনহার সঙ্গে দ্বিতীয় নাম হিসাবে অতিরিক্ত মুখ্য সচিব অজিত রঞ্জন বর্ধনের নাম যুক্ত করে তা পাঠানো হয় রাজভবনে। কিন্তু, তাতেও সন্তুষ্ট হতে পারলেন না রাজ্যপাল। এরপর,আবার তৃতীয় নাম চেয়ে নবান্নের কাছে নোট পাঠায় রাজভবন। এরই মধ্যে ঝটিকা সফরে দিল্লি যান রাজ্যপাল। সূত্রের খবর, দিল্লিতে রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল ও বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড় এর সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন রাজ্যপাল। যদিও, এই বৈঠকের বিষয়ে রাজভবনের তরফে কোন সমর্থন মেলে নি। মঙ্গলবার, দিল্লি থেকে ফিরে বিমানবন্দরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রাজ্যপাল বলেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রাজ্যপালের এই মন্তব্যের পরেই নড়েচড়ে বসে নবান্ন৷
কমিশন ও পঞ্চায়েত আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজ্যের পঞ্চায়েত আইনে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগে রাজ্যপালের পছন্দ অপছন্দের কোন সুযোগ নেই। আইন অনুসারে এই পদে নিয়োগের জন্য কিছু মাপকাঠি রয়ছে। যেমন, আই এ এস বা আই পি এস বা ডব্লু বি সি এস যোগ্যতায় অন্তত ২৫ বছর কাজের অভিজ্ঞতা। রাজ্যে নির্বাচন পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা, ৬৫ বছরের কম বয়স, পূর্বতন দায়িত্বে তার কাজের ট্রাক রেকর্ড বা সার্ভিস রেকর্ড ইত্যাদি। এসব বিষয়ে রাজ্যপাল মনে করলে তথ্য যাচাই করে দেখতে পারেন। কিন্তু, একাধীক নাম চাওয়ার কোন এক্তিয়ার নেই রাজ্যপালের। রাজ্যপাল মনে করলে, রাজ্য সরকারের ফাইলে সই না করে ফেরৎ পাঠাতে পারেন। মতামত জানাতে পারেন। কিন্তু, ওই পর্যন্তই। কারন, আইন অনুসারে এক্ষেত্রে রাজ্যপালের ভূমিকা নিদৃষ্ট। সে কারনেই অতীতে এমনকি ধনকড়ের সময়েও রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে এই জটিলতা তৈরি হয় নি।
প্রশ্ন, তাহলে বর্তমান রাজ্যপালের সময়ে তা হচ্ছে কেন? রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলের একাংশের মতে, এর একমাত্র কারন, রাজভবন ও রাজ্য সরকারে সঙ্গে সমন্বয়হীনতা। সম্পর্কের অবনতি। সিপিএম নেতা রবীন দেবের মতে, “রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে রাজ্যপালের অনুমোদন পেতে এই পরিস্থিতি অতীতে কখনো হয় নি। সমস্যার সমাধানে সরকারের সদিচ্ছার অভাবই এর আসল কারন। এই দেখছেন না, সরকারি কর্মচারিদের মহার্ঘভাতার দাবি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে মূল আন্দোলনকারীদেরই ডাকা হচ্ছে না। এটাও তেমনি। সংবাদমাধ্যমে বার্তা না দিয়ে, মুখ্যমন্ত্রীর উচিত এ বিষয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে সরসরি কথা বলা।” রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের নাম নিয়ে বিজেপির তরফেও রাজ্যপালকে তাদের মতামত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে, রাজীবা সিনহার নাম নিয়ে তাদের বিশেষ কোন আপত্তি ছিল না বলেই সূত্রের খবর। তবে, আজ বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, যেভাবে বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকার, রাজভবনের সঙ্গে সংঘাতের রাস্তায় যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে পঞ্চায়েত নির্বাচন করার ব্যাপারে অনীহা রয়ছে তৃণমূলের।
পর্যবেক্ষকদের মতে, মে মাসে পঞ্চায়েত নির্বাচন ধরে কমিশন যে প্রস্তুতি শুরু করেছিল, অভিষেকের নবজোয়ারের ধাক্কায় তা জুলাইয়ের মাঝামাঝি পৌঁছে গেছিল। এখন, কমিশনার নিয়োগকে ঘিরে রাজভবন আর নবান্নের টানাপোড়েনে নির্বাচন ঘোষনা নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। কমিশনার নিয়োগের জটিলতা কাটলেও, নতুন কমিশনারকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করতে কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ দিন লাগবে। তারপর, কমিশন ও নির্বাচন কর্মীদের ভোটমুখী করতে আরো কিছুদিন প্রয়োজন। সব মিলিয়ে এখনি নতুন কমিশনারের নাম ঘোষনা হলে, পঞ্চায়েত ভোট ঘোষনা হতে জুন মাসের মাঝামাঝি হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন হতে জুলাইয়ের মাঝামাঝি নির্বাচন হওয়া সম্ভব। কিন্তু, কোন কারনে তা আরো দেরি হলে, পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়বে। কারন, অগাষ্টের মধ্যে নির্বাচনের ফল ঘোষনা করে বোর্ড গঠন করতে না পারলে, মেয়াদ উর্তীর্ণ পঞ্চায়েতে প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে। লোকসভা ভোটের জন্য জাতীয় নির্বাচন কমিশন কাজ শুরু করে দেয় অন্তত ৬ মাস আগে, সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে আর পঞ্চায়েত নির্বাচন করা যাবে না।
রাজনৈতিক মহলের মতে, ২০২৪ এর লোকসভা ভোটের আগে, তেমন কিছু হলে রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলের কাছে তা অশনি সংকেত। তাই যেকোন মূল্যে সেই পরিস্থিতি এড়াতে চাইবে তৃণমূল। এটাই আশার কথা।