সাধারণত বাস্তবের কোনও ঘটনা অবলম্বনে সিনেমা বা টিভি সিরিজের গল্প লেখা হয়৷ কিন্তু জেলেনস্কির (Volodymyr Zelenskyy Life)ক্ষেত্রে হয় উল্টো৷ কারণ প্রেসিডেন্টের চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছনোর কয়েক বছরের মধ্যে সত্যি সত্যিই তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট (Ukraine Crisis) নির্বাচিত হন৷ সেই জেলেনস্কিকে এখন গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত মুখ৷ কারণ, রাশিয়ার প্রবল আক্রমণ এবং শত্রুপক্ষের হাতে বন্দি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও দেশ ছেড়ে যেতে নারাজ তিনি৷ বরং সামনে থেকে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট৷ যা দেখে গোটা বিশ্বই ৪৪ বছরের জেলেনস্কির সাহসিকতার প্রশংসা করছে৷
advertisement
টিভি সিরিজে অভিনীত চরিত্রের মতোই বাস্তবেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০১৯ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জেলেনস্কি৷ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এক ধনকুবেরকে পরাজিত করেন তিনি৷ সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ধনকুবেরদের দুর্নীতি থেকে ইউক্রেনকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি৷
আরও পড়ুন: ইউক্রেনের সব রাস্তায় মুছে ফেলা হচ্ছে চিহ্ন, সাইনবোর্ড! কারণ জানলে চমকে উঠবেন
ইউক্রেনের শীর্ষ ক্ষমতা অপ্রত্যাশিতভাবে জেলেনস্কির মতো এমন একজনের হাতে চলে গিয়েছিল, যাঁকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেও ব্যাপক হইচই শুরু হয়৷ প্রতিবেশী দেশের এই বদল ভাল ভাবে নেননি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও৷ সম্ভবত নিজের দেশেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হোক, তা তিনি চাননি৷ কারণ বরাবরই নিজের বিরোধীদের বশে রাখতে পছন্দ করেন পুতিন৷
রাশিয়ায় পুতিনের সবথেকে বড় প্রতিপক্ষ, ঘটনাচক্রে যিনি নিজেও একজন কৌতুক অভিনেতা এবং দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের নেতা অ্যালেক্সেই নাভালনিকে ২০২০ সালে বিষ প্রয়োগ করে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে রাশিয়ার সিক্রেট সার্ভিসের বিরুদ্ধে৷ তাঁর অন্তর্বাসে বিষাক্ত পদার্থ মিশিয়ে এই বিষক্রিয়া ঘটানো হয়েছিল৷ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত অসুস্থ নাভালনিকে চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে যাওয়ার অনুমতি দেয় পুতিন সরকার৷ জার্মানিতে গিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে কিছুটা সুস্থ হয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সেই রাশিয়াতেই ফিরে আসেন নাভালনি৷ সেই নাভালনিকে অবশ্য ফের জেলে পুড়েছেন পুতিন৷ জেলে থাকা অবস্থাতেই ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রতিবাদ করেছেন নাভালনি৷
ঘটনাচক্রে রাশিয়ার নাভালনির মতো ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও একই মতাদর্শে বিশ্বাসী৷ যে পরিণতিই হোক না কেন, নিজেদের বিশ্বাস থেকে সরে আসতে নারাজ তাঁরা৷
আরও পড়ুন: ঘর সামলানো নয়, ইউক্রেনের মহিলারা এখন বাড়িতে বসে 'এই' কাজটিই করছেন...
ইউক্রেনে রুশ হামলার ঠিকে আগের দিন গত বুধবার জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করেছিলেন পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ ডুডা৷ জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষৎ প্রসঙ্গে পোলিশ প্রেসিডেন্ট বলেন, 'প্রতিবেশী দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যদি তাঁর মুখ থেকে শুনতে হয় যে এটাই সম্ভবত আমাদের শেষ সাক্ষাৎ, কারণ নিজের দেশকে রক্ষা করার জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত সেখানেই থেকে যাবেন, তখন তো ভয় লাগেই!'
ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর রাশিয়ার তরফে দাবি করা হয়, জেলেনস্কি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন৷ কিন্তু সেনাবাহিনীর মতো জলপাই রংয়ের পোশাক পড়ে জেলেনস্কি ভিডিও বার্তায় এই খবরকে গুজব বলেও উড়িয়ে দিয়েছেন৷ রাজধানী কিভে নিজের অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে ভিডিও শ্যুট করে দেশবাসীকে সাহস জুগিয়েছেন তিনি৷ প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, দেশকে রক্ষা করার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়বেন৷ তিনি কোথাও যাচ্ছেন না৷ দেশের মানুষকে অস্ত্র তুলে নিতেও আর্জি জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট৷
জিউ ধর্মের জেলেনিস্কির দাদু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত সেনার হয়ে নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়েছেন৷ তাঁর পরিবারের বাকি নাৎসি বাহিনীর আক্রমণে গণহত্যার শিকার হন৷ ফলে লড়াইটা তাঁর রক্তেই রয়েছে৷ বিপদের মুখেও তাঁর মুখে স্মিত হাসি দেখা যাচ্ছে৷ জেলেনস্কি ভালই জানেন, রুশ অভ্যুত্থানকারীদের সামনে তাঁর জীবন সংশয়ও হতে পারে৷
ইউক্রেন ছেড়ে এখন অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডের মতো প্রতিবেশী দেশগুলিতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন৷ বিশেষত পরিবারের মহিলা এবং শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে পুরুষদের অনেকেই দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে সামিল হচ্ছেন৷ জেলেনস্কির স্ত্রী, ১৭ বছরের মেয়ে এবং ৯ বছরের ছেলে অবশ্য ইউক্রেন ছেড়ে পালাননি৷ প্রেসিডেন্টের মতোই দেশে থেকে গিয়েছে তাঁর পরিবারও৷
আমেরিকার তরফে সরকারি ভাবেই জেলেনস্কিকে নিরাপদে ইউক্রেন থেকে বের করে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল৷ জবাবে জেলেনস্কি জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর দেশ থেকে পালানোর ব্যবস্থা না করে ইউক্রেনকে বরং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করুক ওয়াশিংটন৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসলে ইউক্রেনের যুদ্ধ জেলেনিস্কিকেও অনেক পরিণত করে তুলেছে৷ জেলেনস্কি রাশিযার সঙ্গে অসম লড়াইয়ে জিতবেন কি না, তা সময়ই বলবে৷ কিন্তু তার আগে গোটা বিশ্বের মন জিতে নিয়েছেন ভোলোডিমির জেলেনস্কি৷