"পুজোর টানে কেউ বা ফেরেন ঘরে, কেউ বা এই কটা দিন-ই জীবিকার সন্ধানে কাটান কলকাতা থেকে শত-সহস্র মাইল। আর যাঁরা তার কোনোটাই পারেন না? তাঁদের নিয়েই আজকের এই উপাখ্যান। সঙ্গত কারণেই বহু প্রবাসী বাঙালি পুজোর কটা দিন ইচ্ছা থাকলেও ঘরে ফেরার সু্যোগ পান না। কারুর অফিসের ছুটি নেই, কেউ আগের মাসেই সদ্য দেশ থেকে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন, কেউ বা যেতে পারেননি দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে, আবার কারুর হয়তো পরের মাসেই ঘরে ফেরা একান্ত জরুরী। তেমনি এক পারিবারিক কারণে এবারের পুজোতে দেশে ফেরা হয়নি আমারও", বললেন রক্তিম হালদার।
advertisement
নিউজ এইট্টিন বাংলার সঙ্গে দীর্ঘ অনলাইন আড্ডায় রক্তিম জানালেন , 'আমার কাছে পুজো মানে কলকাতায় কটা দিন। বন্ধুবান্ধব নিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে শহরের আলো-আধাঁরি বৃষ্টিভেজা রঙ্গিন অলি-গলি, গলতঘর্ম হয়ে ছেঁড়াচটি টানতে টানতে বাগবাজার, কুমোরটুলি, কলেজস্কোয়ার, ম্যাডক্সের পুরনো প্রেম। ফুটপাথের আনাচে কানাচে বসে বেশ কয়েক কাপ চা অথবা এগরোল, ভিড়ের লাইনে ভুভুজেলা, অষ্টমীতে পাঞ্জাবী, ধুনুচি নাচ সঙ্গে পাড়ার পুজো কিংবা শহরতলির প্রাচীন পুজোয় ঘুরে ঘুরে ভোগের খিচুড়ি, আর ভোররাতে চুপি চুপি বাড়ি ফেরা। বছরে শুধুমাত্র একটি বারের জন্য প্রাণখোলা বাঙালিয়ানাতে মেতে ওঠা'।
আরও পড়ুন: এয়ারপোর্ট অথরিটিতে বিভিন্ন পদে নিয়োগ, বিশদে জানুন ও আবেদন করুন
তাহলে এই বছর কেমন কাটবে রক্তিম বাবুর? বিদেশের এই তরুণ গবেষক জানালেন, "অতিমারী ২০২০ তে প্রতিমা-দর্শন থেকে বঞ্চিত করেছিল। ২০২১-এ দেশে ফিরলেও সদ্য স্বজনহারানোর বেদনা পুজোর আমেজ করেছিল ফিকে। তাই এই বছর একটিবার মা-কে দর্শনের আকুতি নিয়ে হাজির হলাম বার্লিনে। জার্মানিতে দুর্গাপুজো হয় বেশ কিছু বড় শহরে, যেমন, বার্লিন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, মিউনিখ, হামবুর্গ, ড্রেসডেন, কোলন, ব্রেমেন, ইত্যাদি। আর আমরা যাঁরা অপেক্ষাকৃত ছোট্ট শহরের বাসিন্দা তাঁরা পুজোর কটা দিন হয়ে পড়ি পরিযায়ী। কেউ যাই বার্লিন, কেউ বা হামবুর্গ, কেউ আবার পুজোর টানে এই চারদিন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ব্যাগ গুছিয়ে পাড়ি দি প্রতিবেশী দেশে, যেমন ইংল্যান্ডের লন্ডনে, ফ্রান্সের প্যারিসে, অথবা নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে।"
আরও পড়ুন: বটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় জুনিয়র রিসার্চ ফেলো নিয়োগ, দারুণ সুযোগ জানুন
আরও জানান, "বার্লিনে বেশ কয়েকটা পুজো বিশ্ববিখ্যাত। যেমন ক্লাব ইগনাইট। এই পুজো আয়োজিত হয় স্থানীয় এক মন্দিরে, শ্রী গনেশা হিন্দু টেম্পল। জার্মানির মেইন ট্রেন স্টেশন থেকে মাত্র পাঁচ কিমি দূরেই। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় পুজো উদ্বোধন করেন মাননীয় রাষ্ট্রদূত Parvathaneni Harish। তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং রাতে খাওয়া দাওয়ার এলাহি আয়োজন। চারদিনব্যাপী এই পুজোর বিশেষ বৈশিষ্টই হলো বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং দেশ-বিদেশের মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন। শুধু বিভিন্ন অঞ্চলের প্রবাসী ভারতীয়রাই নন, জার্মানির বহু মানুষও এই পুজোয় অংশগ্রহণ করে থাকেন। অষ্টমীতে হয় অঞ্জলী। দেখা হয়ে যায় পুরোনো অনেক বন্ধুর সাথে, নব আনন্দে মেতে উঠি আমরা। পরিচয় হয় বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত বহু মানুষের সঙ্গে।"
আরও পুজোর কথা জানান তিনি। তাঁর কথায়, "এবছর আরেকটি যে পুজোয় প্রতিমা-দর্শনের সু্যোগ হল, তা হলো ক্লাব Sanatani Puja and Sanskriti উচ্চারণ ‘স্প্যাস্’। জার্মানে যার অর্থ হল ফূর্তি বা আনন্দ, যা কিনা প্রকৃত অর্থেই সত্যি। ওয়াটারল্যু-উফের ৭- এ একটি বড় ক্লাবঘরে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয় যা কিনা ইগনাইট এর পুজো থেকে সামান্য দূরে। সোজা মেট্রোলাইন U৭ এ মাত্র তিনটে স্টপ পরেই। নাচে-গানে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় সে এক আশ্চর্য অনুভূতি।"
তারপর আসে ফেরার পালা, পুজোর একরাশ আনন্দ, কোলাহল ছেড়ে, মৃন্ময়ী মা-কে ছেড়ে বহু দূরে, তাঁর ছোট্ট শহর হ্যানোফার-এ ফিরে এলেন রক্তিম বাবু। তিনি মনে একরাশ বিষাদ নিয়ে জানান, "জানি কল্লোলিনী কলকাতায়, সর্বোপরি বাংলায় পুজো কাটানোর অনুভূতি সতত অদ্বিতীয়। পরিবারের সঙ্গে কাটানো অমূল্য মুহূর্তগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। তবুও এ বিদেশ বিভুঁইয়ে বসে পুজোর প্রসাদ পাওয়ার অভিজ্ঞতাও যে অতুলনীয়। অচেনা মানুষদের আপন করে নেওয়া ঘরোয়া পরিবেশ। অবশেষে হাইস্পীড ইন্টারসিটি এস্কপ্রেসে (ICE) বসে জানলা দিয়ে কাশফুলের তোড়া দেখে ফিরতে ফিরতে মনে পড়ে যায় কত স্মৃতি... বাবা মায়ের হাত ধরে প্রথম পাড়ার ঠাকুর দেখা, ঢাকের বাদ্যি শুনে আমার বেড়ে ওঠা, আর আরেকবার দেবীর মর্ত্যধামে আগমণের বছরভর আকুল প্রতিক্ষা"।