হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রর শাহাবাদ মরকন্দ এলাকায় ঠেলা চালাতেন রানির বাবা ৷ মায়ের জীবিকা ছিল পরিচারিকাবৃত্তি ৷ দিনের শেষে কায়ক্লেশে উপার্জন ১০০ টাকা ৷ তবুও মেয়ের নাম রেখেছিলেন ‘রানি’৷ মাথায় মুকুট না থাকলেও হাতে ভাঙা হকি স্টিকের অভাব হয়নি ৷ পরনে মলিন সালোয়ার কামিজ, হাতে ভাঙা স্টিক নিয়েই দৌড়তেন রানি ৷
নামমাত্র দুধে অনেকটা জল মিশিয়েও পেট ভরত না ৷ যথাযথ পুষ্টি তো দূর অস্ত্ ৷ খিদের কথা মনে পড়ত না হাতে হকি স্টিক নিলে ৷ ৬ বছর বয়স থেকেই ওই স্টিক সঙ্গী রানির ৷ প্রথমে শাহাবাদ হকি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষক বলদেব সিংয়ের কাছে অনুশীলন ৷ ২০১০-এ মাত্র ১৪ বছর বয়সে সিনিয়র দলে আত্মপ্রকাশ ৷ বিশ্বকাপে ৭ গোল দিয়ে ভারতীয় দলে সর্বোচ্চ গোলদাতা ৷ নামের পাশে ‘ইয়ং প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট’ পরিচয় ৷
advertisement
এই পরিচয়ের কিছু বছর আগেও রানিকে ‘অপুষ্টির শিকার’ বলে খেলার সুযোগ দিতে চাননি কোচ ৷ বাড়ির কাছেই হকি শেখানোর প্রতিষ্ঠান ৷ সেখানে বাকিদের অনুশীলন দেখে কাটত সময় ৷ একদিন ওই মাঠেই কুড়িয়ে পেলেন পড়ে থাকা বাতিল হকি স্টিক ৷ ভাঙা সেই হাতিয়ার নিয়েই ছুটতেন কিশোরী ৷
ছুটতেন? নাকি পালাতেন? ‘‘আমার জীবন থেকে পালাতে চেয়েছিলাম ৷ বিদ্যুতের অভাব, ঘুমনোর সময় মশার গান, দুবেলা সামান্য খাবার, বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া ঘর—সব কিছু থেকে মুক্তি চাইতাম ৷ আমার বাবা মা তাঁদের সেরাটা নিঙড়ে উজাড় দেওয়ার চেষ্টা করতেন ৷ কিন্তু খুব সামান্যই তাঁদের আয়ত্তে ছিল ৷’’ কিছু বছর আগে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন অধিনায়ক ৷
জানিয়েছিলেন, বহু অনুরোধের পর কোচ রাজি হন প্রশিক্ষণ দিতে ৷ কিন্তু বিধিবাম তারপরও ৷ অরাজি বাবা মা ৷ মেয়ে হকি খেলুক, চাননি রানির বাবা মা ৷
কন্যাসন্তান ঘরের কাজকর্ম করবে, সেটাই দস্তুর ৷ তার বদলে সে কিনা ছোট স্কার্ট পরে মাঠে দৌড়বে ! সম্মত ছিল না রানির বাড়ি ৷ রানি একটা সুযোগ চেয়েছিলেন ৷ বলেছিলেন, ব্যর্থ হলে সব ছেড়েছুড়ে বাবা মা যা বলবেন তাই শুনবেন ৷
নিমরাজি হয়েছিলেন রানির বাবা মা৷ অনুমতি মিলেছিল অনুশীলনে যাওয়ার ৷ ঘড়িহীন বাড়িতে শেষরাত থেকে মা জেগে বসে থাকতেন ৷ আকাশ একটু ফর্সা হতেই ডেকে দিতেন মেয়েকে ৷ কাকভোর থেকে মাঠে শুরু হত অনুশীলন ৷ সেখানে সকলকে বাড়ি থেকে ৫০০ মিলি দুধ নিয়ে যেতে হত ৷ রানি বাড়ি থেকে পেতেন মাত্র ২০০ মিলি দুধ ৷ সকলের চোখের আড়ালে তাতে জল মিশিয়ে নিতেন ৷ খেলতে যে তাঁকে হবেই
এই পর্বে কিন্তু পাশে ছিলেন কোচ ৷ হকি কিটস, জুতো কিনে দেওয়া থেকে শুরু করে নিজের পরিবারে আশ্রয় ৷ খেয়াল রাখতেন রানির খাওয়ার দিকেও ৷ যাতে এক দিনের অনুশীলনও রানির বাদ না যায়, সেদিকে নজর ছিল প্রশিক্ষকের ৷
প্রথম উপার্জনের ৫০০ টাকা রানি তুলে দিয়েছিলেন বাবার হাতে ৷ সেই প্রথম অত টাকা একসঙ্গে হাতে নিয়েছিলেন তাঁর বাবা ৷ তত দিনে একটু একটু করে বিশ্বাস জন্মেছে ‘স্কার্ট পরে খেলা’-তেও সম্মান আছে ৷ মেয়েকে অনুমতি দিয়েছিলেন, নিজের মনের কথা শুনে হকি চালিয়ে যেতে ৷ আত্মীয়স্বজনদের ‘বিয়ে কবে হবে’ প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন রানি৷
সেই যাত্রাপথে রানি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, একদিন তাঁরা নিজেদের বাড়িতে থাকবেন ৷ নিজের কাছে করা সেই প্রতিজ্ঞা তিনি রেখেছেন ৷ ২০১৭ সালে নিজেদের বাড়ি হয়েছে তাঁদের ৷ সেদিন বাবা মাকে জড়িয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন রানি ৷ আজও তাঁদের সকলের চোখে আনন্দাশ্রু ৷
ওই নোনতা স্বাদই বলছে, পদকজয়ের লক্ষ্যে ফাইট রানি, ফাইট !!