আর রথের দিন তো চরম ব্যস্ততা ৷ সন্ধ্যায় রথ টানা হবে ৷ পাড়ার বন্ধুরাও তো রথ নিয়ে বের হবে ৷ তবে, আমার রথটাই যেন সেরা লাগে দেখতে ৷ এ যেন একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা! ছোটবেলার সেই রথের স্মৃতি কতই মধুর ৷ ঠিক একইভাবে রথের দিন কলকাতার যাত্রাপাড়ার সেই জৌলুস এখন ইতিহাস ৷ রথযাত্রার দিনটা এখনও একটু বেশিই বিশেষ দিন যাত্রাশিল্পীদের কাছে ৷ এদিনই হয় যাত্রাপালার বায়না ৷ এদিন থেকে প্রতিবছর নতুন যাত্রার সৃচনা ঘটে ৷ এখন আর তেমন জাঁক নেই ৷
advertisement
চিত্পুরের যাত্রাপাড়া বলতে পুরো চিত্পুর রোডটা নয় ৷ চিত্পুরের যাত্রাপাড়ার ব্যাপ্তি হচ্ছে নতুনবাজার থেকে অ্যালেন মার্কেটের আগে অবধি ৷ কেবলমাত্র তরুণ অপেরা ও নট্ট কোম্পানির অফিস ছিল — শোভাবাজার স্ট্রিট ও হরচাঁদ মল্লিক স্ট্রিটে | অবশ্য তরুণ অপেরার গদিঘর ছিল চিত্পুরেই | এখন তো তরুণ অপেরা বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ নট্ট কোম্পানি অবশ্যই এখনও চিত্পুরের বাইরেই অফিস রেখে আজও ব্যবসা চলাচ্ছে ৷ আর রথযাত্রার দিন দূর-দূরান্তের গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন জেলা থেলে বিভিন্ন ক্লাব,লাইব্রেরি বা অন্য ধরনের সংগঠন দল বেঁধে যাত্রাপালা বুকিং করতে আসেন ৷ বুকিং করার সময় একটা টাকা দিয়ে বুকিং করেন ৷ সুতরাং রথযাত্রার তিথি আসলে চিত্পুরের যাত্রা দলগুলির অগ্রিম রোজগারের একটা দিন ৷ নায়েক পার্টিদের অগ্রিম বুকিংয়ের সঙ্গে মিষ্টির প্যাকেট, ক্যালেন্ডার ও পোস্টার দেওয়া হয় — যাতে তাঁরা তাঁদের জায়গায় ফিরে গিয়ে প্রচার শুরু করতে পারেন ৷ নায়েক পার্টি বুকিংয়ের বিনিময়ে একটা নির্দিষ্ট হারে কমিশন পেয়ে থাকেন ৷
সেই কারণে কোনও কোনও যাত্রাদলের অফিসে বিশেষ পুজোর ব্যবস্থাও হয় এখনও ৷ অনেক লোকজনের সমাগম ঘটে এই পুজোকে কেন্দ্র করে ৷ অনেকে আবার সিন্নিও পুজোয় দিতেন ৷ দুপুরে সেই সিন্নি ও ফলমূল প্লেটে সাজিয়ে সকলকে দেওয়া হতো সহৃদয়ে, সমাদরের সঙ্গে | আগেকার দিনে বেশিরভাগ দল বাংলা ক্যালেন্ডার ছাপাত পালার নাম, নায়ক-নায়িকার নাম ও সুরকারের নাম দিয়ে | এই ক্যালেন্ডারের বেশ চাহিদা ছিল নায়েক পার্টির কাছে | রথযাত্রার দিন মালিকরা পালাকার, সুরকার — এঁদের প্রত্যেককে কিছু অগ্রিম দিতেন | এই অগ্রিম দেওয়াকে বলা হয় ‘সাইদ’ করা ৷ অনেক দলে সুরকারের রথের দিন একটু সুরও করে দিতে হতো ৷ একে বলা হত ‘সুরভাঙা’. অনেক দলে নাটকও পড়া হত ৷
আগে রথযাত্রার দিন চিত্পুরের যাত্রাপাড়ায় লোকে লোকারণ্য হত ৷ শিল্পী ও সুরকার ও পালাকারদের পকেট গরম হতো ৷ নায়েক পার্টিরা বড় থলে ভরে মিষ্টির প্যাকেট, ক্যালেন্ডার ও পোস্টার নিয়ে ঘরে ফিরে যেতেন বুকভরা আশ্বাস নিয়ে | যাত্রাপালার গান হলে পাড়ার ভেঙে পড়া ক্লাবঘরটার ছাউনি হবে, লাইব্রেরির বই কেনা যাবে ৷ আগে যাত্রা হতো ষষ্ঠী থেকে জ্যৈষ্ঠি | অর্থাত্ দুর্গাপুজোর ষষ্ঠি থেকে জৈষ্ঠ্য মাস অবধি ৷ কমবেশি একশো আশি দিন থেকে দুশো দিন ৷ এখন হোম এন্টারটেনমেন্টের যুগে পুরনো যাত্রার সে সুদিন আর নেই ৷ তবু বাংলার যাত্রা আছে, ছিল এবং থাকবে ৷ লোকশিক্ষা ও মনোরঞ্জনের মাধ্যম হয়ে ৷