উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশে বান্দায় এপ্রিল মাসে তাপমাত্রার পারদ চড়েছিল প্রায় ৪৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এছাড়াও দেশের অন্যান্য অনেক জায়গাতেও তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গিয়েছে। আবহাওয়া বিজ্ঞানী এম মহাপাত্র (Mrutyunjay Mahapatra) জানিয়েছেন যে, এপ্রিল মাসে উত্তর-পশ্চিম ও মধ্য ভারতের গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। ছাপিয়ে গিয়েছে বিগত ১২০ বছরের তাপমাত্রাকেও। রাজধানী দিল্লিতে ৭২ বছরের সর্বোচ্চ গরম রেকর্ড করা হয়েছে এপ্রিলে। গত শুক্রবার তাপমাত্রা ছিল সর্বাধিক। আবহাওয়া দফতরের (IMD) পূর্বাভাস অনুযায়ী, মে মাসে পশ্চিম, মধ্য, উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাপপ্রবাহ চলবে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এই তাপপ্রবাহের প্রভাব নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং বিপজ্জনক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হচ্ছে বলেই মনে করছেন তাঁরা। আর এর প্রভাব পড়ছে মানবদেহেও। আসলে অতিরিক্ত গরম বা তাপপ্রবাহের কারণে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এমনকী মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
advertisement
আরও পড়ুন : আসছে ঘূর্ণিঝড় অশনি! পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে কীভাবে চলছে মোকাবিলার প্রস্তুতি? দেখুন ছবি
রিপোর্ট অনুযায়ী, তাপপ্রবাহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ। কারণ তাপপ্রবাহ অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষজনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শুধু তা-ই নয়, পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হয়ে ওঠে। যখন তাপের তীব্রতা এবং পুনরাবৃত্তির হার বৃদ্ধি পায়, তখন মৃত্যুর হারের সম্ভাবনা নির্ধারণের জন্য একটি চিহ্ন থাকে। আর এই চিহ্নটাই হল ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার বা ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা (wet bulb temperature)। কিন্তু বিষয়টা ঠিক কী? সেই বিষয়েই আজ আলোচনা করে নেওয়া যাক।
ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার কী?
মানুষ যে পরিমাণ তাপ এবং আর্দ্রতা সহ্য করতে পারে, তা তাপপ্রবাহের প্রভাবের সবচেয়ে গুরুতর কঠিন সীমাগুলির মধ্যে একটি। এটি ওয়েট বাল্বের তাপমাত্রা ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এটি পরিমাপ করে থাকেন। আর এটি এমন একটা তাপমাত্রা, যেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্দ্রতায় জল বাষ্পীভূত হতে পারে না। মানবদেহ কতটা দক্ষতার সঙ্গে তার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এটি তার প্রক্সি হিসাবে কাজ করে। মানুষের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা হল ৬ ঘণ্টার জন্য ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। এর থেকে তাপমাত্রা বেড়ে গেলেই বিপত্তি। সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষও তাতে গুরুতর ও প্রাণঘাতী শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।
বিভিন্ন সময়ে ইরান, পাকিস্তান এবং ভারত-সহ সমস্ত ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এই তাপমাত্রা স্তরের কাছাকাছি থেকেছে বা সেই তাপমাত্রার স্তর অতিক্রম করেছে। গোটা বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও তাপের তীব্রতা মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৯ সাল থেকে বিশ্বে ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রার সীমায় পৌঁছে যাওয়া এলাকার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
আরও পড়ুন : কালোই ভালো, গরমে তৈলাক্ত ত্বকের যত্নে এই প্যাকই সেরা, বানান বাড়িতেই
মানুষের শরীরের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়েট বাল্বের তাপমাত্রা:
বাতাসে যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে আর্দ্রতা থাকে না, তখন ঘাম শরীরকে শীতল রাখে। তাপকে জলের আকারে বার করে দিয়ে আমাদের দেহ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। আর জলের আকারে বেরিয়ে যাওয়া তাপ ত্বকের পৃষ্ঠের উপর বাষ্পীভূত হয়। এই জল বায়ুমণ্ডলে বাষ্পীভূত হওয়ার জন্য, এটি অবশ্যই উচ্চ থেকে নিম্ন বাষ্প চাপের দিকে প্রবাহিত হয়।
আরও পড়ুন : গরমে তেলতেলে নাকে অসংখ্য় ব্ল্যাকহেডস? হাতের কাছেই আছে ঘরোয়া সমাধান
যদিও শুধুমাত্র ঘামই শরীর ঠান্ডা করে না। এর পাশাপাশি বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শরীর থেকে তাপ অপসারণ করতে হয়। পরিবেশে পর্যাপ্ত জলীয় বাষ্প থাকলে চাপের পার্থক্য হয়, যা সাধারণত ঘামকে বাষ্পীভূত হতে দেয়, ত্বকের উপরে লেগে থাকে না। জল নির্গমন ছাড়াও ঘাম শরীরে লেগে থাকে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য উত্তপ্ত হয়। আর এর ফলে দেহ অতিরিক্ত গরম হয়ে যেতে পারে এবং শরীরের প্রাথমিক অঙ্গগুলি বিকল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
কলম্বিয়া ক্লাইমেট স্কুলের ল্যামন্ট রিসার্চ প্রফেসর র্যাডলি হর্টন সায়েন্স অ্যাডভান্সেস-র জার্নালে এই গবেষণার বিষয়ে লিখেছেন। তাঁর বক্তব্য, ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা এমন একটি জায়গায় পৌঁছতে পারে, যা মানুষের সহনশীলতার ঊর্ধ্বে। তিনি আরও জানিয়েছেন, ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওয়েট বাল্বের তাপমাত্রা হল শারীরবৃত্তীয় সর্বোচ্চ সীমা। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা হলে তা প্রাণঘাতী। এমনকী এই প্রসঙ্গে তিনি এ-ও বলেন যে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষ হালকা পোশাক পরে প্রচুর জল খেয়ে সারাদিন ছায়াতে বসে থাকলেও এই সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন।
তাপপ্রবাহের অন্য কিছু প্রভাব কি আছে?
হিট সিনকোপ (Heat Syncope), ক্র্যাম্প (Cramps), ক্লান্তি (Fatigue) থেকে হিট স্ট্রোকের (Heat Stroke) মতো ছোটখাটো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা কখনও কখনও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার পারদ বাড়ার সঙ্গে সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করেছেন। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন যে, তাপপ্রবাহের কারণে রোদে পোড়া (Sunburn) এবং ছত্রাকের সংক্রমণ (Fungal Infections) হতে পারে। গান্ধীনগরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেল্থ-এর ডিরেক্টর দিলীপ মাভালঙ্কার বলেছেন যে, তাপপ্রবাহের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি ছোট এবং বড়- দুইই হতে পারে, যা কখনও কখনও মৃত্যুর বা স্থায়ী স্নায়বিক ক্ষতির (Neurological Damage) কারণ হয়ে উঠতে পারে। ছোটখাটো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে মাভালঙ্কার বলেন, "প্রচণ্ড তাপ জলশূন্যতার কারণ হতে পারে, বিশেষ করে যাঁরা বাইরে বেরিয়ে কাজ করেন, তাঁদের জন্য। এছাড়াও হিট ক্র্যাম্প (পেশিতে খিঁচুনি), ক্লান্তির মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের কারণে হিট সিনকোপ (জ্ঞান হারানো বা মাথা ঘোরা) হতেও পারে। হিট স্ট্রোকের দরুন রক্তের তাপমাত্রাও বেড়ে যায় এবং মস্তিষ্কে প্রোটিন জমে যায়। এটি স্নায়বিক ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং কখনও কখনও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বয়স্ক ও অন্য অসুস্থতা রয়েছে, এমন ব্যক্তিরা সাধারণত বেশি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। প্রচণ্ড তাপ হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুসের মতো অঙ্গগুলির উপর আরও চাপ সৃষ্টি করে। কারণ তারা তাদের ক্ষমতার বাইরে কাজ করে, যা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আসলে বাইরে বার না-হয়েও কেউ পরোক্ষ ভাবে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন।"
ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা সীমার ক্ষেত্রে ভারতের ছবিটা কী রকম?
নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখেছেন যে, ১৯৭৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব উপকূলীয় ভারত এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের হটস্পটগুলিতে ওয়েট-বাল্ব তাপমাত্রা ছিল সর্বনিম্ন ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্তত একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে মধ্য আমেরিকা, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে সর্বাধিক ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি বা অতিক্রম করেছে। তাপপ্রবাহ এবং এর সমস্যাগুলির মধ্যে একটি গভীর প্রতিক্রিয়ার বিষয়ও রয়েছে। আমাদের দেহে তাপের যে সাধারণ সীমা থাকা উচিত, তা হল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা। এর বাইরে শরীর নিজেকে ঠান্ডা করতে লড়াই করে।
উদাহরণস্বরূপ, উত্তর মালির অনেক সম্প্রদায় অবশ্যই জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের বর্ষা মরসুমে কিছুটা হলেও আরামে থাকে। কারণ, বছরের বাদবাকি সময়ে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়। তাপমাত্রার প্রভাব পড়ে মানুষের স্বাস্থ্য, কৃষি এবং গবাদি পশুর উপর। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তরুণ প্রজন্মের কাছে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। কারণ তারা এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারছে না।
তবে বন্য়া ও খরার তুলনায় অত্যধিক তাপমাত্রার বিপদের বিষয়টি তুলনায় কম গুরুত্ব পেয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের উপর রাষ্ট্রসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (COP26) ২৬তম সম্মেলনে আফ্রিকার দেশগুলিতে অত্যধিক তাপের স্বাস্থ্যগত প্রভাবগুলির উপর আলোচনা হয়েছে। এখন নারী, নবজাতক শিশু এবং দরিদ্রদের মতো দুর্বল গোষ্ঠীগুলির উপরে উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব কীভাবে মোকাবিলা করা যায় বা কম করা যায়, তার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।
এটা অনেক মানুষের জন্য একটি ভয়ঙ্কর বাস্তব:
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত হবে। তাপপ্রবাহ হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। যখন শরীর তার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তখন অভ্যন্তরীণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে কিডনি বা শ্বাসকষ্টের মতো নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গি জ্বরের মতো সংক্রামক রোগ আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। কারণ ম্যালেরিয়া বহনকারী মশার মতো বাহকের জন্য আরও জায়গা আদর্শ হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে খরা আরও বাড়বে, ফলস্বরূপ ফসলের ক্ষতি এবং গবাদি পশুর মৃত্যু হবে। এর ফলে অপুষ্টি দেখা দেবে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে। শিশুদের বৃদ্ধির উপরেও প্রভাব পড়বে।