ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক নিয়ন্ত্রক জানিয়েছে, জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে অপারেটিং কুলিং সিস্টেমে (Cooling System) জরুরি শক্তি সরবরাহ করতে কম ডিজেল জেনারেটর ব্যবহার করতে তারা বাধ্য হবে। এই সিস্টেমগুলির ব্যর্থতা জাপানের ফুকুশিমা (Fukushima Nuclear Disaster) প্ল্যান্টের মতোই একটি বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ২০১১ সালে ভূমিকম্প এবং সুনামি ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কুলিং সিস্টেমগুলিকে ধ্বংস করে, যার কারণে তিনটি চুল্লি গলে যাওয়া শুরু করে।
advertisement
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, "পারমাণবিক প্ল্যান্টে কিছু হলে পরিণতি হবে ব্যাপক এবং ভয়াবহ। যদি বিস্ফোরণ হয় তাহলে সবাই শেষ হয়ে যাবে, ইউরোপ শেষ হয়ে যাবে।" মধ্যরাতের ভাষণে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য রাশিয়ার নেতৃত্বকে চাপ দেওয়ার জন্য অন্য দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন জেলেনস্কি৷ তিনি বলেন, "ইউরোপের জরুরি পদক্ষেপই রাশিয়ান সেনাদের থামাতে পারে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপর্যয় থেকে ইউরোপের মৃত্যু হতে দেবেন না। রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে।" তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে 'পরমাণু সন্ত্রাস' চালানোর অভিযোগ তুলেছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, রাশিয়া ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি চায়।
আরও পড়ুন : আবার চালু হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা, দেশের উড়ানবাণিজ্যে এর গুরুত্ব কোথায়?
কী হয়েছিল?
ইউক্রেনের কৌশলগত বন্দর নগরী খারসন (Kherson) দখল করার পর রাশিয়ান বাহিনী জপোরিঝিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চলে চলে আসে এবং বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এনেরহোদার পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাওয়ার পথ খোলার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে আক্রমণ করে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কীভাবে আঘাত করা হয়েছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়, তবে এনেরহোদার মেয়র দিমিত্রো অরলভ বলেছেন যে একটি রাশিয়ান সামরিক কনভয়কে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে যেতে দেখা গিয়েছিল এবং শহরে জোরে গুলির শব্দ শোনা গিয়েছিল। পরে শুক্রবার ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ জানায়, রাশিয়া পারমাণবিক কেন্দ্রটি দখল করে নিয়েছে। প্ল্যান্টের মুখপাত্র আন্দ্রি তুজ (Andriy Tuz) ইউক্রেনীয় টেলিভিশনকে বলেছেন যে শুক্রবার ভোরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে গোলাগুলি চলে এবং ছয়টি চুল্লির মধ্যে একটিতে আগুন লেগে যায়। টুজ আরও বলেছেন যে প্রাথমিকভাবে অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা আগুনের কাছাকাছি যেতে সক্ষম হয়নি। কারণ তাদের গুলি করা হয়েছিল।
শুক্রবার ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পর রাষ্ট্রসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি-র ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল গ্রোসি (Rafael Grossi) বলেছেন, "চুল্লিতে নয়, চুল্লির পাশের একটি বিল্ডিংয়ে গুলি লেগে যায়। প্লান্টের ছয়টি চুল্লির সমস্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা মোটেও প্রভাবিত হয়নি এবং তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ হয়নি। তবে অপারেটর এবং নিয়ন্ত্রক আমাদের বলছেন যে পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং হতে চলেছে।"
কী হতে পারে?
বর্তমানে একটি রিঅ্যাক্টরের সংস্কারের কাজ চলছিল। কাজেই ওই রিঅ্যাক্টর এখন কাজ করছে না। কিন্তু প্ল্যান্টের ভেতরে পারমানবিক জ্বালানি রয়েছে। অন্য ছ'টি চুল্লির মধ্যে চারটি এখন কাজ করছে না, শুধুমাত্র একটি চালু আছে। প্ল্যান্টের চুল্লিগুলিতে পুরু কংক্রিট কন্টেনমেন্ট গম্বুজ রয়েছে, যা তাদের ট্যাঙ্ক এবং আর্টিলারি থেকে রক্ষা করে। মার্কিন প্রশাসনের প্রাক্তন এক নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন উলফস্টাল বলেছেন, "পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ড কখনই ভাল নয়। আমরা চাই না যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি আক্রমণের শিকার হোক, আগুনে পুড়ে যাক।"
পারমাণবিক সুবিধার আরেকটি বিপদ হল পুল, যেখানে খরচ করা জ্বালানি রডগুলিকে ঠান্ডা করার জন্য রাখা হয়, যা গোলাগুলির জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং যা তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণের কারণ হতে পারে। সম্ভবত সবচেয়ে বড় সমস্যা প্লান্টের পাওয়ার সাপ্লাই। ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক নাজমেদিন মেশকাতি বলেছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটলে জরুরি ডিজেল জেনারেটরের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হতে হয়। এতে জ্বালানি ফুরিয়ে যেতে পারে, যার ফলে একটি স্টেশন ব্ল্যাকআউট হতে পারে, যা জ্বালানি পুলকে ঠান্ডা করার জন্য প্রয়োজনীয় জল তোলা বন্ধ করে দেবে। এটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের।"
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ কেমিক্যাল অ্যান্ড বায়োমোলিকুলার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ডেভিড ফ্লেচার উল্লেখ করেছেন যে কুলিং সিস্টেমে সমস্যা দেখা দিলে চুল্লি বন্ধ করে দেওয়া হলেও কোনও সুরাহা হবে না। আসল উদ্বেগের বিষয় হল চেরনোবিলে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়কর বিস্ফোরণ নয়, বরং কুলিং সিস্টেমের ক্ষতি যা চুল্লি বন্ধ করার সময়ও প্রয়োজন। এই ধরনের ক্ষতিই ফুকুশিমায় বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।"
আরও পড়ুন : অসুস্থ স্বামী কর্মহীন, টোটো চালিয়ে অন্নসংস্থান দুই সন্তানের মায়ের
এখন উদ্বেগের বিষয় কী?
ইউক্রেন পারমাণবিক শক্তির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। চারটি স্টেশনে ১৫টি চুল্লি রয়েছে। যা দেশের প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। জাপোরিঝিয়াতে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং অন্য রাষ্ট্রপ্রধানরা সেখানে যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্যামিহালের সঙ্গে কথা বলার পরে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি-র ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল গ্রোসি ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিকে বিপদে ফেলতে পারে এমন কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য সমস্ত পক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। শ্যামিহাল পশ্চিমা দেশগুলিকে দেশের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলির উপরে আকাশ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, "এটি সমগ্র বিশ্বের নিরাপত্তার প্রশ্ন।"
ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রে এলাকায় তেজস্ক্রিয়তা এখনও লিক হচ্ছে। ইতিমধ্যেই এই এলাকার দখল নিয়ে নিয়েছে রাশিয়ার সেনা। গ্রোসি এই সপ্তাহের শুরুতে চেরনোবিলের কর্মীদের নিরাপদ এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে দেওয়ার জন্য রাশিয়ার কাছে আবেদন করেছিলেন। তিনি বলেন, "দু'টি ঘটনা এই ঝুঁকিকে তুলে ধরে যে সশস্ত্র সংঘর্ষের সময় পরমাণু স্থাপনাগুলি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, যার কারণে গুরুতর পরিণতি হতে পারে।"
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-র পারমাণবিক নীতি কর্মসূচির সহ-পরিচালক জেমস অ্যাক্টন বলেছেন, পারমাণবিক স্থাপনাগুলিকে নিরাপদ রাখার সহজ চাবিকাঠি হল তাদের চারপাশে যে কোনও সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করা। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একটি চুল্লির কুলিং সিস্টমে সমস্যা, জরুরি ডিজেল জেনারেটর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং দ্রুত মেরামত না হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।"
চেরনোবিল বিপর্যয়: ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (Soviet Union) চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনাটি চেরনোবিল বিপর্যয় হিসাবে পরিচিত। চেরনোবিল বর্তমান ইউক্রেনের অবস্থিত। এই পারমাণবিক দুর্ঘটনাকে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় হিসেবে গণ্য করা হয়। চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট পারমাণবিক চুল্লির সংখ্যা ছিল ৪টি। ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল চতুর্থ পারমাণবিক চুল্লি থেকেই দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়। দুর্ঘটনাটি মূলত ঘটেছিলো কুলিং সিস্টেম সংক্রান্ত একটি পরীক্ষা চালানোর সময়। রাতের শিফটের কর্মীরা ভুল করে পারমাণবিক চুল্লিটির টার্বাইনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শীতল জল প্রবাহিত করে। ফলে সেখানে বাষ্প কম উৎপাদিত হয়। এতে করে পারমাণবিক চুল্লিটি উত্তপ্ত হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে বিস্ফোরণ ঘটে। বাইরের বাতাস ঢুকে পড়লে পারমাণবিক চুল্লির দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে সেখানে বিরাট অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। আগুন ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এতে করে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় তৈরি পদার্থ পরিবেশে প্রায় ১ কিলোমিটার উচ্চতা অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল এবং প্রচুর পারমাণবিক ধুলো পরিবেশের ব্যাপক দূষণ ঘটিয়েছিল। দুর্ঘটনার ফলে উদ্ভূত মেঘটি ইউক্রেন, বেলোরুশ, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ ছাড়িয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে, গ্রেট ব্রিটেনে এমন কি পূর্ব আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল।
ফুকুশিমায় কী ঘটেছিল?
এগারো বছর আগে ১১ মার্চ এক শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল জাপানের (Japan) পূর্ব উপকূলে। ভূমিকম্পের কারণে সুনামি হয় (Tsunami), আর তাতে তছনছ হয়ে যায় ওকুমায় অবস্থিত ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বড় ধরণের ঢেউ আঘাত হানে ফুকুশিমা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এবং এর পারমানবিক চুল্লি প্লাবিত হয়ে যায়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রর ছয়টি চুল্লির দু'টিতে বিস্ফোরণ ঘটে, এর পরেই আরও তিনটি চুল্লিতে আংশিক গলন ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে। নিকটবর্তী অঞ্চলের বহু বাসিন্দাকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির আশেপাশে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা প্রতি ঘণ্টায় ৪০০ মিলিসিভার্টে পৌঁছে যায়। বিপর্যয়ে তাৎক্ষনিকভাবে কেউ মারা যায়নি তবে বিস্ফোরণে কেন্দ্রটির ১৬ জন কর্মী আহত হয়েছিলেন।