কী ভাবে ভারতীয় ক্রিকেট দলে ফিরিয়ে আনা হল মহেন্দ্র সিং ধোনিকে
বলাই বাহুল্য, আর যা-ই হোক না কেন, আর্থিক প্রয়োজনে মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলে ফিরে আসার দরকার পড়েনি। সেই প্রশ্নই ওঠে না, যত-ই খেলার দুনিয়া থেকে অবসর তিনি গ্রহণ করুন না কেন, উপার্জনের তাঁর অভাব নেই, নানা সময়েই বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় তাঁর নাম উঠে আসে খবরের শিরোনামে। ২২ গজ থেকে সরে গিয়ে মহেন্দ্র সিং ধোনি মন দিয়েছিলেন জৈব পদ্ধতিতে কৃষিকাজে, সঙ্গে নানা ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্ট তো ছিলই বরাবরের মতো! এছাড়া রয়েছে তাঁর নিজস্ব প্রোডাকশন হাউজ এমএসডি এন্টারটেনমেন্ট (MSD Entertainment)। সব চেয়ে বড় কথা হল, মহেন্দ্র সিং ধোনি খেলার দুনিয়া থেকে পুরোপুরি সরে কিন্তু যাননি, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (Indian Premier League), সংক্ষেপে যা IPL নামে সারা বিশ্বে পরিচিত, তার অন্যতম দল চেন্নাই সুপার কিংস-এর (Chennai Super Kings) অধিনায়ক হিসাবে তাঁর খেলোয়াড় সত্ত্বার দাপট প্রতি বছরেই নতুন করে চোখে পড়ে।
advertisement
আরও পড়ুন: রবি শাস্ত্রীর জায়গায় কি এবার ধোনি ভারতীয় দলের কোচ! বিসিসিআই কীভাবে দিল ইঙ্গিত, দেখুন
ফলে, এটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে মহেন্দ্র সিং ধোনির এই ফিরে আসা অনেকটাই ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্সের স্বার্থে, লিমিটেড ওভারের খেলায় তাঁর কিংবদন্তি প্রতিভাকে কাজে লাগানোর জন্যই এই উদ্যোগ। জানা গিয়েছে যে ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের মেন্টর হিসাবে দায়িত্ব সামলানোর প্রস্তাব মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দিয়েছিলেন বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (Board of Control for Cricket in India), সংক্ষেপে BCCI-এর অনারারি সেক্রেটারি জয় শাহ (Jay Shah), দুবাইয়ে এক বৈঠকে তিনি এই প্রস্তাব পেশ করেছিলেন খেলোয়াড়ের কাছে। মহেন্দ্র সিং ধোনি এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন, তার পরে পাকা খবর দিয়ে একটি ট্যুইট করা হয়েছে বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার অফিসিয়াল Twitter হ্যান্ডেল থেকে। অবশ্য তার আগে এই বিষয়ে ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলি (Virat Kohli) এবং সহঅধিনায়ক রোহিত শর্মার (Rohit Sharma) সঙ্গে একপ্রস্থ আলোচনা সেরে নিতেও ভোলেননি শাহ।
ভারতীয় ক্রিকেট দলে কোচ বনাম মেন্টর
তাহলে ঠিক কোন জায়গায় আলাদা হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের বর্তমান কোচ রবি শাস্ত্রী এবং বর্তমান মেন্টর মহেন্দ্র সিং ধোনির কাজ? এই জায়গায় এসে সবার আগে একটা কথা স্পষ্ট করে বলে না নিলেই নয়- বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোচ এবং মেন্টরের পদমর্যাদাগত কোনও পার্থক্য নির্ণয় করে দেয়নি, ঠিক তেমন ভাবেই আবার কোচ এবং মেন্টরের কাজ কী হবে, সেই নিয়েও পৃথক ভাবে কোনও নির্দেশিকা জারি করা হয়নি। তার পরেও ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের কোচ এবং মেন্টরের কাজের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম সীমারেখা প্রতিষ্ঠা করাই যায়! বলা যায় যে, একজন কোচের কাজ হল সামগ্রিক ভাবে দল এবং দলের সদস্য খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের দেখভাল করা, তার উন্নতিসাধন করা। অন্য দিকে, মেন্টরও ঠিক একই কাজ করবেন, তবে সামগ্রিক স্তরের পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগত স্তরেও সম্পর্করক্ষা করবেন খেলোয়াড়দের সঙ্গে, পৃথক ভাবে প্রত্যেকের পারফরম্যান্সের উন্নতির প্রতি যত্নবান হবেন।
আবার আমাদের ঘুরে-ফিরে এসে দাঁড়াতে হয় প্রশ্নের মুখে। খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের এই যে উন্নতিসাধন করা, তার জন্য যে পদ্ধতি মেনে চলতে হয়, তা কি কোচ এবং মেন্টরদের জন্য আলাদা আলাদা হতে পারে? আদতে তো খেলা একটাই, আবার কোচ যেমন করে তাঁর দলকে তৈরি করেন, কেরিয়ারের শুরুর দিকে সেই সব নির্দেশ মেনেই তো মহেন্দ্র সিং ধোনির ইস্পাতকঠিন প্রতিভা ক্ষুরধার হয়ে উঠেছে, ফলে কাজ কী ভাবে আলাদা হতে পারে কোচ এবং মেন্টরের? সত্যি কথা বলতে কী, যে সব টেকনিক এবং অ্যাপ্রোচে দলকে গড়ে-পিটে নেবেন কোচ রবি শাস্ত্রী, কিছুটা একই পথে হাঁটতে হবে মহেন্দ্র সিং ধোনিকেও, প্রায়শই মুছে যাবে কাজের দিক থেকে উভয়ের পদক্ষেপের সীমারেখা। শেষ পর্যন্ত যা পড়ে থাকে, তা হল একান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা!
আরও পড়ুন: ধোনিকে নিয়ে সৌরভের বড় বয়ান! তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া
অর্থাৎ কোচ এক্ষেত্রে টেকনিক, ট্রেনিং আর গাইডেন্সের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের তৈরি করবেন। অন্য দিকে, মেন্টর প্রয়োজন অনুসারে নতুন করে তা প্রয়োগ করতেও পারেন, কিন্তু তাঁর মুখ্য অবলম্বন হচ্ছে ব্যক্তিগত স্তরে পরামর্শ, ২২ গজে যখন খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষের চাপের মুখে পড়বেন, তখন তিনি নিজে কী করে সেই চাপ কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, সেই কথা বলে, নিজের অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিয়ে খেলোয়াড়দের পথ দেখাবেন মেন্টর, সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়ের ক্ষমতা এবং দুর্বলতার মূল্যায়ণ করে তাঁদের পথ দেখাবেন। এই দিক থেকে হিসাব করলে দেখলে কোচের সঙ্গে খেলোয়াড়ের সম্পর্ক হবে অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক, কিন্তু মেন্টরের সঙ্গে সম্পর্ক হবে ব্যক্তিগত, অনেকটা বন্ধুর মতো!
কেন মহেন্দ্র সিং ধোনিকেই বেছে নেওয়া হল মেন্টর হিসাবে
দেশীয় স্তরের ঘটনা যখন, তখন বিতর্ক সহজে শেষ হওয়ার নয়! অনেকেই দাবি তুলেছেন যে বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার সভাপতি যখন খোদ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Sourav Ganguly) মতো কিংবদন্তি ক্রিকেট-তারকা, তখন তিনি কি এই দায়িত্ব সামলাতে পারতেন না? অভ্যন্তরীণ বিতর্ক এড়িয়ে গিয়েও বলা যায় যে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে সভাপতি হিসাবে এমনিতেই যথেষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। পাশাপাশি, কেন মহেন্দ্র সিং ধোনিকে প্রয়োজন, সে কথা এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর একদা সতীর্থ গৌতম গম্ভীরও (Gautam Gambhir)। তিনি তাঁর বক্তব্যে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে সেভাবে দেখলে রবি শাস্ত্রীর তুলনায় ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের মহেন্দ্র সিং ধোনির আলাদা করে কিছু দেওয়ার নেই। তার পরেও সব হিসাব ওলোট-পালোট করে দিচ্ছে ক্যাপ্টেন কুল-এর অনন্য অভিজ্ঞতা এবং চাপের মুখে মাথা ঠাণ্ডা রাখার অবিসংবাদী দক্ষতা। অতীতে একাধিকবার এই ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে যে নক আউট ম্যাচের মোকাবিলায় হিমসিম খেয়েছে ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল। তাই টেস্ট ম্যাচে বিরাট কোহলির দল ভালো খেললেও লিমিটেড ওভারের ম্যাচে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য মহেন্দ্র সিং ধোনি এবং তাঁর পরামর্শের প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করছেন সকলে।
এছাড়াও রয়েছে আসন্ন সিরিজে ইউনাইটেড আরব এমিরেটসের পিচের প্রসঙ্গ, সেখানে বল স্পিন করানো খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়! এই দিক থেকে হ্যান্ড-হোল্ডিং স্পিনিংয়ের প্রতি মহেন্দ্র সিং ধোনির বিশেষ প্রবণতা বিপক্ষের উইকেট ফেলতে কাজে আসবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
শেষ হয়ে হইল না শেষ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore) ছোটগল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে যা বলেছিলেন, বিতর্ক ব্যাপারটাও প্রায় তেমনই, সব যুক্তি খণ্ডন করা হলেও একটা না একটা পেরেক মাথা তুলে থাকবেই! মেন্টর হিসাবে মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের দায়িত্ব সামলানোর আগেই তাই দেখা দিয়েছে আইনি জটিলতা! জানা গিয়েছে যে মধ্যপ্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (Madhya Pradesh Cricket Association), সংক্ষেপে MPCA-র তরফ থেকে এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন সঞ্জীব গুপ্তা (Sanjeev Gupta), তিনি এই মর্মে একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার কাছে।
আরও পড়ুন: Dhoni-র অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতেই তাঁকে মেন্টর করা , সাফ কথা BCCI প্রেসিডেন্ট Sourav-র
সেই চিঠিতে সঞ্জীব গুপ্তা সুপ্রিম কোর্টের (Supreme Court) অনুমোদন করা লোধা কমিটির (Lodha Committee) আইন উল্লেখ করে জানিয়েছেন যে নিয়ম অনুসারে একই ব্যক্তি একই সঙ্গে দুই পদের দায়িত্ব সামলাতে পারেন না। ভারতীয় সংবিধনের ৩৪ (৪) ধারার উল্লেখ করে তাঁর চিঠিতে সঞ্জীব গুপ্তা এই আপত্তি তুলেছেন যে মহেন্দ্র সিং ধোনি আপাতত খেলার জগতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের চেন্নাই সুপার কিংসের অধিনায়ক হিসাবে, এই দিক থেকে তিনি ইতিমধ্যেই বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত, ফলে ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের মেন্টর হিসাবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করা যেমন সংবিধানবিরোধী, তেমনই অনৈতিকও বটে!
তবে চিঠি পেয়ে চুপ করে বসে থাকেনি বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া! তারা জানিয়ে দিয়েছে যে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হবে, অ্যাপেক্স কাউন্সিল আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে কী ভাবে বিতর্কের মীমাংসা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করবে। আশা করাই যায়, খুব তাড়াতাড়ি এই বিষয়ে নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা জানাবে তারা। আপাতত শুধু ভক্তদের একটাই সান্ত্বনা- ফের ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের সঙ্গে মহেন্দ্র সিং ধোনির নাম জুড়ল তো বটে!