কীভাবে শুরু হল বিক্ষোভ?
এই আন্দোলনের বেশিরভাগই কারণ কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর (Justin Trudeau) বিরুদ্ধে দীর্ঘ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে করছেন অনেকে। লিবারেল পার্টির (Liberal Party) রাজনীতিবিদ ট্রুডো ২০১৫ সাল থেকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী। দেশের রক্ষণশীলদের একটা অংশ তাঁকে পছন্দ করেন না। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ আলবার্টা (Alberta), এটি দেশের সবচেয়ে রক্ষণশীল প্রদেশ। বর্তমান বিক্ষোভের আগে ২০১৯ সালে বিক্ষোভকারীরা ট্রুডো সরকারের নতুন কার্বন ট্যাক্সের (Carbon Tax) বিরোধিতা করেছিল। তারা পশ্চিম কানাডা থেকে অটোয়ায় কয়েকশো ট্রাকের একটি কনভয় নিয়ে যাত্রা করে। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল এই সিদ্ধান্ত তেল শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একই বছর অর্থনৈতিক অবিচারের বিরুদ্ধে ফরাসি প্রতিবাদ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য অনেকে হলুদ ভেস্ট পরেছিলেন। এই বছরের 'ফ্রিডম কনভয়' জানুয়ারিতে শুরু হয়েছিল। প্রথমে গাড়ির কনভয় দেশের পশ্চিমাঞ্চল থেকে যাত্রা শুরু করে এবং পরে অন্য জায়গা থেকে বিক্ষোভকারীরা এতে যোগ দেয়।
advertisement
বিক্ষোভকারীদের দাবি কী?
করোনা অতিমারী (Covid-19) রুখতে জাস্টিন ট্রুডো সরকার কানাডায় টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। নয়া নিয়মে আমেরিকা-কানাডা সীমান্ত পারাপারের সময় ট্রাক চালকদের টিকাকরণের শংসাপত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। টিকা না নেওয়া থাকলে ১৪ দিনের কোয়ারিন্টনে থাকতে হবে বলেও জানানো হয় সরকারি নির্দেশিকাতে। এই সিদ্ধান্তের পরই বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। যাই হোক, এটি একটি দ্বিপাক্ষিক সিদ্ধান্ত, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ২২ জানুয়ারি একই নিয়ম আরোপ করেছে। এর অর্থ হল কানাডা নিয়ম তুলে নিলেও আদতে কোনও কিছুই পরিবর্তন হবে না। ওটাওয়া, অন্টারিও এবং অন্যত্র বিক্ষোভকারীরা ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট, মাস্কের প্রয়োজনীয়তা-সহ অন্যান্য বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। যদিও এগুলির বেশিরভাগই প্রাদেশিক সরকারগুলি জারি করেছিল। তবুও, বিক্ষোভকারীরা ট্রুডোর পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে।
কারা কারা আন্দোলনে জড়িত?
'ফ্রিডম কনভয়' (Freedom Convoy) জানুয়ারির শুরুতে কানাডা ইউনিটি (Canada Unity) নামের একটি সংগঠন ঘোষণা করে। কনভয়টির প্রধান সংগঠকদের মধ্যে কানাডার জেমস বাউডার (James Bauder) রয়েছেন। যিনি ‘কিউঅ্যানন ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ (QAnon Conspiracy Theories) বিশ্বাসীদের একজন। সংগঠকদের আরেকজন, লিখ হলেন পশ্চিম কানাডার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের একজন নেতা। যিনি পূর্বে অতি-ডান মাভেরিক পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই দলটি স্বাধীন পশ্চিম কানাডা গঠনের দাবি করে আসছে বহুদিন ধরেই। লিখ আবার রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের প্রাক্তন সদস্য।
তবে এই বিক্ষোভে কতজন প্রকৃত বাণিজ্যিক ট্রাক চালক রয়েছেন তা নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধছে। অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডোগ ফোর্ড শুক্রবার বলেছিলেন যে তাঁরা গুনে দেখেছেন যে মোট গাড়ির মধ্যে হাতেগোনা পাঁচটি বাণিজ্যিক গাড়ি ছিল। বাকিগুলি সবই ব্যক্তিগত গাড়ি, নিরানব্বই শতাংশ ট্রাকার তাদের পিছনে কাজ করছে। এছাড়াও কিছু অতি-ডানপন্থী ব্যক্তিত্ব তাদের আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ফ্রিডম কনভয়কে পুঁজি করার চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ কী করছে?
ট্রুডো ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন যে প্রতিবাদকারীদের অনেকেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী। প্রধাননমন্ত্রীর বক্তব্য সামনে আসার পর উত্তেজনা কমার বদলে আরও বেড়ে গিয়েছে। যদিও, ট্রাকচালক এবং ট্রাকিং সংগঠনগুলি এই বিক্ষোভের ব্যাপক নিন্দা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কানাডিয়ান ট্রাকিং অ্যালায়েন্স (Canadian Trucking Alliance)। যারা বলেছে যে তারা রাস্তায় বিক্ষোভের বিরোধিতা করে এবং কানাডিয়ান ট্রাকচালকদের বেশিরভাগকেই টিকা দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় কানাডায় অতিমারী বিধিনিষেধ অনেক বেশি কঠোর, তবে কানাডিয়ানরা মূলত সরকারকেই সমর্থন করেছে। দেশের হাসপাতালের ক্ষমতা কম, তাই সংক্রমণ বেড়ে গেলে প্রদেশগুলি দ্রুত লকডাউন জারি করেছে। কানাডায় কোভিডে মৃত্যুর হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবারও কানাডায় এই প্রতিবাদের প্রতি অনেকেই সমর্থন দিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump)। যিনি জাস্টিন ট্রুডোর কঠোর নীতির সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছেন। ট্রাম্পের অভিযোগ, ট্রুডো কানাডাকে ধ্বংস করেছেন। অনেকেই ট্রাকারদের নায়ক এবং দেশপ্রেমিক বলে অভিহিত করেছেন। টেসলার (Tesla) ধনকুবের এলন মাস্কও (Elon Musk) সমর্থন জানিয়ে ট্যুইট করেছেন।
অ্যাম্বাসাডর ব্রিজ: উইন্ডসরে বিক্ষোভকারীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (USA) যাওয়ার অ্যাম্বাসেডর ব্রিজ সীমান্ত ক্রসিং (Ambassador Bridge Border Crossing) বন্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসায়। সেতুটি কানাডার অন্টারিও (Ontario) প্রদেশের উইন্ডসর (Windsor) ও যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান (Michigan) অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়টের মধ্যে। উইন্ডসরের (Windsor) মেয়র জানিয়েছেন, পুলিশ প্রয়োজনে বিক্ষোভকারীদের জোর করে ওই জায়গা থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেতু দিয়েই দুই দেশের মধ্যে মোট বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ হয়। এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন ৩২৮ মিলিয়ন ডলার পণ্য পারাপার হয়। সেতুটি উভয় দেশের খাদ্য সরঞ্জামের পাশাপাশি অটো শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন- বুস্টার শটের পরেও কি আবার টিকার ডোজ নিতে হবে? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ ওটাওয়া দখলের চেষ্টা রুখতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা আশা করছে অপরাধমূলক অভিযোগ, ট্রাফিক টিকিট এবং জ্বালানি না পাওয়ার কারণে এই বিক্ষোভ থেমে যাবে। দেশের একটি আদালত এই সপ্তাহে একটি অন্তর্বর্তী আদেশে জানিয়েছে, ওটাওয়া শহরের কেন্দ্রস্থলে হর্ন বাজানো যাবে না। পুলিশ সতর্ক করেছে যে রাস্তায় অবরোধকারী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হতে পারে এবং তাদের যানবাহন আটক করা হতে পারে। যদিও, বিক্ষোভকারীদের দাবি যে তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে। তবে, অটোয়ার বাসিন্দারা বলেছেন যে তাদের হয়রানি করা হয়েছে। সরকার শনিবার বলেছে যে অবরোধ অবশ্যই তুলে নিতে হবে। তারা সতর্ক করে দিয়েছে যে তথাকথিত 'ফ্রিডম কনভয়কে' শেষ করার জন্য প্রতিটি বিকল্প প্রয়োগ করা হবে। শনিবার পুলিশের আসল লক্ষ্য ছিল কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যের জন্য একটি প্রধান ধমনী অ্যাম্বাসাডর ব্রিজে অবরোধ মুক্ত করার। সেই লক্ষ্য কিছুটা সফলও হয় তারা। ইতিমধ্যেই ওটাওয়া ও অন্টারিও প্রদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
ওটাওয়াতে কী হচ্ছে?
দুই সপ্তাহ আগে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী প্রাথমিকভাবে অটোয়া ঢুকে পড়ে তাদের গাড়ি নিয়ে। তাদের সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। তবে চারশোর বেশি ট্রাক সংসদ ভবনের সামনে পার্ক করা রয়েছে। সেখানে একটি অস্থায়ী রান্নাঘর করা হয়েছে। বিক্ষোভ মূলত শান্তিপূর্ণই রয়েছে। কিন্তু অনেকই অভিযোগ করেছেন যে বিক্ষোভকারী জাতীয় যুদ্ধ স্মৃতিসৌধে প্রস্রাব করেছে। সংগঠকদের বাইরেও কানাডার বিক্ষোভটি অন্যান্য উগ্রপন্থীরা রয়েছে, বিক্ষোভস্থলে নাৎসিদের স্বস্তিকা, কনফেডারেট পতাকা ও অন্যান্য উগ্রপন্থী প্রতীক ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক বিক্ষোভকারী ট্রুডোকে উল্লেখ করে অশ্লীল অপমান সহ চিহ্ন বা পতাকা বহন করছে।
ওটাওয়ার মেয়র জিম ওয়াটসন গত সপ্তাহে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন তিনি বলেছেন যে বিক্ষোভগুলি বাসিন্দাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ অনেককে হয়রানি করা হচ্ছে। স্থানীয়রা অবিরাম হর্ন বাজানোর বিষয়ে অভিযোগ করলেও আদালতের আদেশ পাওয়ার পর সেই সমস্য়া মিটে গিয়েছে।