ভারতের আপত্তি কোথায়?
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক এক বিবৃতিতে বলেছে যে ভারত এই ইস্যুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত এবং গভীরভাবে তথ্য বিনিময় করেছে। মন্ত্রক বলেছে যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার বিশ্লেষণে টায়ার ওয়ান দেশগুলি থেকে প্রাপ্ত মৃত্যুর পরিসংখ্যান ব্যবহার করে টায়ার টু দেশগুলির মৃত্যুর পরিসংখ্যান দিতে চাইছে। টায়ার টু দেশগুলির মধ্যে রয়েছে ভারত। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, "ভারতের প্রধান আপত্তির জায়গাটা ফলাফল নিয়ে ছিল না। ছিল সকলের জন্য একই গণনাপদ্ধতি নিয়ে। মডেলটি টায়ার ওয়ান দেশগুলির ডেটা ব্যবহার করার সময় এবং ভারতের ১৮টি রাজ্যের অযাচাইকৃত ডেটা ব্যবহার করার সময় অতিরিক্ত মৃত্যুর অনুমানের দুটি অত্যন্ত ভিন্ন সেট দেয়। অনুমানের এত বিস্তৃত পরিবর্তন এই ধরনের মডেলিং অনুশীলনের বৈধতা এবং নির্ভুলতা সম্পর্কে উদ্বেগ উত্থাপন করে।"
advertisement
সরকার একাধিকবার তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে: স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মতে, ভারত তার উদ্বেগগুলি অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলির কাছে একাধিক আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের মাধ্যমে জানিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে পাঠানো ছয়টি চিঠি ও ভার্চুয়াল বৈঠক। ভারত ছাড়াও চিন, ইরান, বাংলাদেশ, সিরিয়া, ইথিওপিয়া এবং মিশর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে উদ্বেগের মধ্যে বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যে কী করে একই মডেল ভারতের মতো ভৌগোলিক আকার ও জনসংখ্যার দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার পাশাপাশি অল্প জনসংখ্যার দেশের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যাবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, এই প্রয়োগপদ্ধতি তিউনিসিয়ার মতো ছোট দেশের পক্ষে নির্ভুল হলেও ভারতের মতো ১৩০ কোটি জনসংখ্যার বিশাল দেশের পক্ষে তা প্রযোজ্য় নাও হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মডেলে অনেক সাধারণীকরণ আছে: মডেলটি মাসিক তাপমাত্রা এবং মাসিক গড় মৃত্যুর মধ্যে একটি বিপরীত সম্পর্ক অনুমান করে, যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ভারত একটি মহাদেশীয় অনুপাতের দেশ। সেখানে জলবায়ু এবং ঋতু পরিস্থিতি বিভিন্ন রাজ্য জুড়ে এবং এমনকী একটি রাজ্যের মধ্যেও ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়- তাই সমস্ত রাজ্যের ঋতুর ধরনগুলি ব্যাপকভাবে বৈচিত্র্যময়। সুতরাং, এই ১৮টি রাজ্যের তথ্যের উপর ভিত্তি করে জাতীয় স্তরের মৃত্যুহার অনুমান করা উচিত নয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গ্লোবাল হেল্থ এস্টিমেটস (GHE 2019), যার উপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় স্তরের দেশগুলির মডেলিং করা হয়েছে, এটি নিজেই একটি অনুমান। বর্তমান মডেলিং অনুশীলনটি ঐতিহাসিক অনুমানের আরেকটি সেটের উপর ভিত্তি করে নিজস্ব অনুমান সরবরাহ করছে বলে মনে হচ্ছে, যা দেশেরই উপলব্ধ ডেটা উপেক্ষা করে করা হয়েছে। এটা স্পষ্ট নয় কেন গ্লোবাল হেল্থ এস্টিমেটস ভারতের মৃত্যুর পরিসংখ্যান অনুমান করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে টায়ার ওয়ান দেশগুলির জন্য তাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক ডেটাসেটগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, যখন এটি বারবার হাইলাইট করা হয়েছে যে ভারতে ডেটা সংগ্রহের একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা এবং ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
ভারতে পুরুষ ও মহিলার মৃত্যুর সংখ্যা গণনা করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৬১টি দেশের বয়স এবং লিঙ্গের মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে এবং তারপরে সেগুলিকে অন্যান্য দেশে (ভারত সহ) চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। চারটি দেশ (কোস্টা রিকা, ইজরায়েল, প্যারাগুয়ে এবং তিউনিসিয়া) দ্বারা রিপোর্ট করা মৃত্যুর বয়স-লিঙ্গ বণ্টনের (Age-Sex Death Distribution) উপর ভিত্তি করে ভারতেও মৃত্যুর বয়স-লিঙ্গ বণ্টন করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে এই ভেরিয়েবলগুলির সংমিশ্রণটি ৯০টি দেশ এবং ১৮ মাসের (জানুয়ারি ২০২০-জুন ২০২১) নমুনার নিরিখে অতিরিক্ত মৃত্যুর পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য সবচেয়ে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে এই ভেরিয়েবলগুলির সংমিশ্রণটি কীভাবে সবচেয়ে সঠিক, তার প্রমাণ এখনও মেলেনি।
ভারতে ভিন্ন কী রয়েছে?
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "ভারতে কোভিড সংক্রমণের হার (Rate Of Covid Infection) কোনও সময়েই সারা দেশে অভিন্ন ছিল না। কিন্তু, ভারতের মধ্যে কোভিড পজিটিভিটির হারের এই পরিবর্তনটিকে মডেলিংয়ের উদ্দেশ্যে বিবেচনা করা হয়নি। এছাড়াও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরমর্শের চেয়েও ভারত অনেক দ্রুত গতিতে কোভিড পরীক্ষা (Covid Test) করেছে। ভারত পরীক্ষা পদ্ধতি হিসাবে মলিকিউলার টেস্ট পছন্দের তালিকায় বজায় রেখেছে এবং শুধুমাত্র স্ক্রিনিং করার উদ্দেশ্য হিসাবে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট (Rapid Antigen Test) ব্যবহার করেছে। ভারতের জন্য মডেলটিতে এই কারণগুলি খতিয়ে দেখা হয়েছে কি না সে বিষয়ে এখনও উত্তর দেওয়া হয়নি।"
আরও পড়ুন- করোনা আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান! জানুন ভ্যাকসিন সংক্রান্ত জরুরি তথ্য়!
ভারতে সংক্রমণের গতি রোখার জন্য অনেক কোয়ারান্টিন পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়েছে (যেমন স্কুল বন্ধ, কর্মক্ষেত্র বন্ধ, পাবলিক ইভেন্ট বাতিল)। কিন্তু, ভারতের মতো একটি দেশের জন্য এইভাবে নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন ব্যবস্থার পরিমাপ করা আসলে অসম্ভব, কারণ এই ধরনের কঠোর ব্যবস্থা রাজ্য এবং জেলাগুলির মধ্যেও ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। অতএব, এই প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করা পদ্ধতি খুবই বিতর্কিত। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "এছাড়াও, এই ধরনের ব্যবস্থার পরিমাণ নির্ধারণের জন্য বিষয়গত পদ্ধতিতে সর্বদা প্রচুর পক্ষপাতিত্ব জড়িত থাকে। যা অবশ্যই বাস্তব পরিস্থিতি উপস্থাপন করবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই পরিমাপের বিষয়গত পদ্ধতির বিষয়ে একমত হয়েছে। এটি এখনও ব্যবহার করা হয়।"
বিবৃতি অনুসারে, "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে আলোচনার সময় এটিও হাইলাইট করা হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স সহ কয়েকটি টায়ার ওয়ান দেশের কোভিড ডেটার অফিসিয়াল রিপোর্টিংয়ে কিছু ওঠানামা মহামারীবিদ্যার জ্ঞানকে অস্বীকার করেছে। ইরাকের মতো একটি দেশকে টায়ায় ওয়ানে অন্তর্ভুক্ত করাও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেশগুলিকে শ্রেণীবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল্যায়ন এবং এই দেশগুলি থেকে মৃত্যুর রিপোর্ট তৈরি করা সন্দেহ জাগিয়েছে। যদিও ভারত সহযোগিতা করার জন্য তার দ্বার খুলে রেখেছে। কারণ এই জাতীয় ডেটা সেটগুলি নীতি নির্ধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে সহায়ক হবে। ভারত বিশ্বাস করে যে নীতিনির্ধারকদের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার জন্য পদ্ধতির উপর গভীরভাবে স্পষ্টতা এবং এর বৈধতার স্পষ্ট প্রমাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি খুবই আশ্চর্যজনক যে যখন নিউ ইয়র্ক টাইমস ভারতের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোভিড মৃত্যুর কথিত পরিসংখ্যান পেতে পারে, তবে এটি অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে পেতে অক্ষম ছিল কীভাবে!
বিরোধীদের তোপ: এদিকে দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাকে ঘিরে শাসক–বিরোধী দলের মধ্যে তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে। করোনায় মৃত্যু নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে (Narendra Modi) নিশানা করেছে বিরোধীরা। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর (Rahul Gandhi) অভিযোগ, মোদিজি নিজেও সত্য কথা বলেন না, অন্যকেও সত্য কথা বলতে দেন না। ট্যুইটে রাহুল লেখেন, "অক্সিজেনের অভাবে কারও মৃত্যু হয়নি বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু এটাও মিথ্যা। আমি আগেই বলেছিলাম, ৫ লাখ নয়, বরং ৪০ লাখ মানুষের করোনায় মৃত্যু হয়েছে সরকারের অবহেলার জন্য। মোদিজির কাছে অনুরোধ, করোনায় যে সব পরিবারের লোকজন প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে ৪ লাখ টাকা করে আর্থিক সাহায্য দিক সরকার।" কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রও (Mahua Moitra)। প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি বিঁধে মহুয়া বলেন, "মিথ্যা কথা বলে, তথ্যকে চেপে গিয়ে সত্যকে থামিয়ে রাখা যায় না। ভারতের সরকারি হিসাবে কোভিডে মৃত্যু ৫.২ লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এটি ৮ গুণ বেশি। বাস্তবের মুখোমুখি হোন ও শিক্ষা নিন। ৫৬ ইঞ্চি ৫৬ লাখকে ঢেকে রাখতে পারবে না।"