TRENDING:

'এত বড় সম্মান আগে কখনও পাইনি', ভাষাদিবসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়

Last Updated:

"আমার ইচ্ছে আছে, আমার আশা আছে, অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এদেশে ফিরে আসব, এই দেশটাকে ভাল করে দেখব।"-সত্যজিৎ রায়

impactshort
ইমপ্যাক্ট শর্টসলেটেস্ট খবরের জন্য
advertisement
(১৯৭২ সাল। অনেক রক্তের বিনিময়ে সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের ঢাকার পল্টন ময়দানে ভাষাদিবসের প্রধান অতিথি ছিলেন সত্যজিৎ রায়। নিজের দেশের কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গিয়েছিল কি? মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আজকের যে সম্মান তার কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়। এখানে তুলে ধরা হল সেই বিরল বক্তৃতা। )
advertisement

বহু দিন থেকে শহিদ দিবসের কথা শুনে আসছি। ২১ ফেব্রুয়ারির কথা শুনে আসছি। কিন্তু এখানে এসে নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না, আমি বুঝতে পারতাম না যে, আপনারা বাংলা ভাষাকে কতখানি ভালবাসেন। বাংলা ভাষা যখন বিপন্ন তাকে বাঁচানোর জন্য যে সংগ্রাম হয়েছিল তাতে যাঁরা আত্মোৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের যে কত শ্রদ্ধা করেন আপনারা, তা আমি এখানে এসে বুঝতে পারছি। আমরা, যারা পশ্চিমবঙ্গে থাকি, আমরাও বাংলা ভাষাকে ভালবাসি। এটা ঠিক যে, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির মধ্যে আরও পাঁচ রকম সংস্কৃতির প্রভাব এসে পড়ে সেটাকে একটা পাঁচমিশালি ভাব এনে দিয়েছে। ইংরেজির প্রভাব আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তার একটা কারণ এই বোধহয় পশ্চিমবাংলা হল ভারতবর্ষের একটা প্রাদেশিক অংশমাত্র। কিন্তু তাই বলে এই নয়, আমরা বাংলা ভাষাকে ভালবাসি না।বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান, বাংলা চলচ্চিত্র, বাংলা থিয়েটার- এ সবই পশ্চিমবঙ্গে এখনও বেঁচে আছে, টিঁকে আছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র এদের আমরা এখনও ভালবাসি।

advertisement

আমি ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি, আমি আজ বিশ বছর ধরে বাংলা ছবি করছি। এর মধ্যে বহুবার বহু জায়গা থেকে অনুরোধ এসেছে যে আমি বাংলা দেশ, বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করে অন্য দেশে অন্য ভাষায় চিত্ররচনা করি। কিন্তু আমি সেই অনুরোধ বারবার প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ আমি জানি, আমার রক্তে যে ভাষা বইছে তা হল বাংলা ভাষা। আমি জানি সেই ভাষাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় কিছু করতে গেলে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে। আমি কূলকিনারা পাব না। শিল্পী হিসেবে আমি মনের জোর হারাব।

advertisement

সেবারের বাংলাদেশ সফরের দুর্লভ ছবির পেপারকাটিং। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সত্যজিৎ রায়। চিত্রগ্রাহক-টুলু দাশ।

আমি ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি যে, পূর্ববঙ্গে নাকি আমার দেশ। আমার ঠাকুরদাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়ের নাম হয়তো আপনারা কেউ কেউ শুনেছেন। আমার তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু শিশুকাল থেকে আমি তাঁর রচিত 'ছেলেভোলানো পূর্ববঙ্গের কাহিনি', 'টুনটুনির বই' পড়ে এসেছি। ভালবেসে এসেছি। তাঁর রচিত গানে আমি পূর্ববঙ্গের লোকসঙ্গীতের আমেজ পেয়েছি।

advertisement

বাংলাদেশের বিশিষ্ট ছাত্রনেতাদের সঙ্গে শ্রীরায়। চিত্রগ্রাহক-টুলু  দাশ

যদিও এদেশে আমি কখনও আসিনি, আমার দেশে আমি কখনও আসিনি বা স্থায়ী ভাবে আসিনি, এইসব গান, এইসব রূপ কথা শুনলে আমার মনে হত এই দেশের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ রয়েছে। যখন আমার পাঁচ কি ছয় বছর বয়স, তখন আমি একবার ঢাকা শহরে এসেছিলাম। দু'তিনদিন মাত্র ছিলাম। আমার মামাবাড়ি ছিল ওয়ারিতে, রঙ্কেন স্ট্রিটে। সে বাড়ি এখনও আছে কিনা জানিনা। সে রাস্তা এখনও আছে কিনা জানি না। বাড়ির কথা কিছু মনে নেই। মনে আছে শুধু প্রচণ্ড বাঁদরের উপদ্রব, সে বাঁদরও এখনও আছে কিনা তাও আমি জানি না। তারপর মনে আছে, পদ্মায় স্টিমারে আসছি, ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গিয়েছে, মা আমায় বাইরে ডেকে এনে দেখাচ্ছেন পদ্মায় সূর্যোদয় হচ্ছে। আর দেখাচ্ছেন, পদ্মায় যেখানে শীতলক্ষা এসে মিশেছে সেখানে এক নদীর জলের সঙ্গে অন্য নদীর জলের কত তফাৎ। সেই থেকে বারবার মনে হয়েছে, একবার নিজের দেশটা গিয়ে দেখে আসতে পারলে ভাল হত। কিন্তু সেই আসাটা, বিশেষত দেশবিভাগের পর, ক্রমেই দুরাশায় পরিণত হতে চলছিল।

advertisement

হঠাৎ কিছুদিন আগে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেল। আমার কাছে আমার দেশের দরজা খুলে গেল। এবং আজ শহিদ দিবসে এসে, আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে, ঢাকা শহরে এসে, আমার স্বপ্ন অন্তত কিছুটা অংশে সফল হল। এবার আমি অনেক জরুরি কাজ ফেলে চলে এসেছি। এবার আর বেশিদিন থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আমার ইচ্ছে আছে, আমার আশা আছে, অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এদেশে ফিরে আসব, এই দেশটাকে ভাল করে দেখব। এদেশের মানুষের সঙ্গে এমন ভাবে জনসভায় নয়, সামনাসামনি মুখোমুখি বসে তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করব।

আমি আর বিশেষ কিছু বলতে চাইনা। আপনারা যে আমার কাজের সঙ্গে পরিচিত,আমার কাজ সম্বন্ধে আপনাদের কৌতূহল রয়েছে সে খবর আমি আগেই পেয়েছি। কয়েক বছর আগে যখন মহানগর ছবিটি দেখানো হয়েছিল তাতে এখানকার জনসাধারণ কী ধরনের আগ্রহ, কৌতূহল প্রকাশ করেছিল, তার ফলে কী ঘটনা উদ্ভব হয়েছিল, সে খবর যখন আমার কানে পৌঁছয় সে কথা আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু তারপর এখান থেকে বহু পরিচিত-অপরিচিত ব্যক্তি, বন্ধু আমাকে চিঠি লিখে খবরের কাগজের খবর কেটে পাঠিয়ে ছবি কেটে পাঠিয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন সেই ঘটনার কথা, তখন বিশ্বাস হয়েছিল, আর বিশ্বাস হয়ে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভাবতে পারিনি এটা হতে পারে। একজন শিল্পী হিসেবে এর চেয়ে বড় গর্বের বিষয়, এর চেয়ে বড় সম্মান আর কিছু হতে পারে না।

সেরা ভিডিও

আরও দেখুন
লালগোলাতে রাজরাজেশ্বরী রূপে পূজিতা হন মা কালী! দেওয়া হয় ইলিশের ভোগ
আরও দেখুন

গত বিশ বছরে অনেক জায়গায় অনেক দেশে অনেকবার নানা ভাবে সম্মানিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু আমি জোর গলায় আজকে এখানে দাঁড়িয়ে এই শহিদ দিবসের পূণ্যতিথিতেই আমি বলতে পারি, আজকে যে সম্মান সেই সম্মানের কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়। এর চেয়ে বড় সম্মান আমি কখনও পাইনি। আর আমার মনে হয় না আর কখনও পাব। জয় বাংলা।

বাংলা খবর/ খবর/বিনোদন/
'এত বড় সম্মান আগে কখনও পাইনি', ভাষাদিবসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়
Open in App
হোম
খবর
ফটো
লোকাল