TRENDING:

Shaonli Mitra: 'কেন চেয়ে আছ, গো মা'; শাঁওলি, রবীন্দ্রনাথ ও ঋত্বিক

Last Updated:

গান শেষ হওয়ার পর শাঁওলি কান্নায় ভেঙে পড়েন ঋত্বিকের বুকে। যে আশ্রয়ের সন্ধানে ছবির শুরু থেকে এঁদের যাত্রা শুরু, সেই আশ্রয়ের ভাঙা বাড়িতে যেন স্থান হয় শাঁওলির।

impactshort
ইমপ্যাক্ট শর্টসলেটেস্ট খবরের জন্য
advertisement
আগুনের পার্টি হয়? দেশ? কাঁটাতার? শত্রুপক্ষ? না বোধহয়। তখন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে 'বঙ্গবালা'-র দেহ। রবিবার রাতে যখন বজ্রাঘাতের মতো এসে পৌঁছল খবর, প্রয়াত শাঁওলি মিত্র। গালে-কপালে হাত বুলিয়ে ঋত্বিক ও দেবব্রত, দুই যুগন্ধর গেয়েছিলেন ভাঙা বাংলার পরিবারগীতি, 'কেন চেয়ে আছ, গো মা', সেই শাঁওলি, সেই বঙ্গবালা পুড়ে গেলেন! মায়ের কথা মনে করিয়ে পুড়ে গেলেন অনাথবৎ বাংলার আর্কেটাইপ শাঁওলি। যে আগুন ছিল ঋত্বিকের মগজে, দেবব্রতর কণ্ঠে, কাঁটাতারের যন্ত্রণায়, দেশহারাদের ভুখা পেটে, সে আগুন শরীরে নিয়ে পুড়ে গেলেন শাঁওলি। যে পথ দিয়ে হেঁটে এসেছেন সদত হাসান মান্টো থেকে মৌসুমী ভৌমিক, সেই ঘরছাড়া জনতার দেবী-রূপ শাঁওলি নিভৃত চেতনে, খানিকটা গোপনে, চুপ করে, প্রয়াত হলেন ১৬ জানুয়ারি।
ছবির অংশ
ছবির অংশ
advertisement

'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো' ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায়, ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ছবি। ঋত্বিকের স্ত্রীয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তৃপ্তি মিত্র, আর বঙ্গবালার চরিত্রে শাঁওলি মিত্র। ছবির ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের মাথায়, ক্যামেরা ক্লোজে ধরে দাওয়ায় ঠেস দিয়ে বসে থাকা গল্পের প্রধান চরিত্রাভিনেতা ঋত্বিক ঘটককে। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। বাঁশির পূর্ব-সুরের মধ্যেই ঋত্বিকের স্বভাবসিদ্ধ নাকের গোড়ায় হাত চালানো ও হাত উল্টে অবজ্ঞা প্রকাশ। শুরু হয় গান, রচনাবলীতে উল্লিখিত 'জাতীয় সঙ্গীত', ১৮৮৪ সালে রচিত - কেন চেয়ে আছ, গো মা। বারবার ঋত্বিকের ছবিতে ফিরে এসেছে বাংলার দেবীর প্রত্নপ্রতিমা (আর্কেটাইপ), যে ভাবে এই গানেও ফ্রেমে প্রবেশ করে শাঁওলির মুখ, সেখানেও আছে সেই আভাস। ঋত্বিক অপেক্ষাকৃত উচ্চতায় খাটো, কিছুটা উপরে শাঁওলির মুখ। মুহূর্তে মনে পড়ে কুমারটুলির কোনও শিল্পীর প্রতিমার চক্ষু অঙ্কনের এক দৃশ্য। ভাল করে দেখবেন, মনে পড়বেই। যেন যত্নে মুখ ব্যাঞ্জনা করছেন মৃৎশিল্পী। সেই শিল্পী ঋত্বিক, যাঁর আঙুলে বারবার রচিত হয়েছে ভাঙা বাংলার দেবী প্রতিমার রূপ, আর সেই প্রতিমা শাঁওলি।

advertisement

গানের ফ্রেম থেকে ফ্রেমে যাত্রা বর্ণনা করলে কার্যত ভাঙা বাংলাদেশের এক ইতিহাস সন্দর্ভ রচনা করা সম্ভব। আজ সে আলোচনা থাক। আজ বরং ওই একটি বাঙাল ভাষায় কথা বলা, মায়ের মুখ নিয়ে কয়েকটা কথা হোক। মায়েরই তো মুখ।

ফুলভারের কোনও প্রয়োজন নেই

advertisement

গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে স্পষ্ট করে লিখে গিয়েছিলেন শিল্পী। ফুলভার কীসের? শ্রদ্ধার ফুলভার? বাংলাদেশে ঐতিহাসিক মাতৃত্বের রূপ কেমন? নারী স্বাধীনতা, রাজনৈতিক প্রতর্ককে যদি দূরে রেখে সত্যিটা যাচাই করে দেখতে যাই, তাহলে বহুলাংশ পাঠকের অন্দরমহলে নজর রাখলেই নজরে পড়বে এক জরাজীর্ণ মাতৃত্বের ছবি। যেখানে নীরবতাই প্রামাণ্য জাতীয় সঙ্গীত। কেমন? মায়ের সকালে হেঁশেলে যাওয়া, গেরস্থালির খেয়াল রাখা থেকে শুরু করে দুপুরে নিভৃতে শীতের রোদে বসে চুল আঁচড়ে ফেলা, কিংবা ক্ষুদামান্দ্যের দোহাই দিয়ে ভাতের টান পড়া হাঁড়ির শেষ-টুকু সন্তানের পাতে চালান করে দিয়ে মুড়ি আর একঢোক জল খেয়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দেওয়া! বাংলাদেশ তো আমেরিকা বা ইংলন্ড নয়, বাংলাদেশ বাংলাদেশই। মাতৃত্বের এই ঐতিহাসিক দৈন্য কী ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হয়েছে? যদি হত, তাহলে ১৮৮৪ সালে জাতীয় সঙ্গীতের অন্তর্ভুক্ত একটি গান কার্যত একই প্রেক্ষাপটে ঋত্বিক প্রয়োগ করতেন? জাতের মাতৃত্ব নিরন্ন, বারবার বিশ্বাসঘাতকতায় দীর্ণ, মিথ্যা আশ্বাস বেণী করে পড়েছেন জট পড়ে যাওয়া চুলে। তাই ভাঙা বাংলার দাওয়ায় বসে, চার-পুরুষের এক বিলাপগীতি রচনা আসলে বাঙালির আত্মসমর্পণ জাতির মাতৃত্বের পায়ে। কী নিয়তি! ১০০ বছরের ব্যবধানে গীত এক সঙ্গীত, যেন সম-ইতিহাস ও সম-চৈতন্যের বিলাপ তুলে আনে। কোথায় তুমি শাঁওলি?

advertisement

ফাইল ছবি

আহ্, শিল্পী যে কেন অমর হয় না।

সিএএ আন্দোলন মনে আছে? মনে আছে রোহিত ভেমুলার মা-কে? বঙ্গদেশের আত্মা বঙ্গবালাকেও মনে আছে! ছবিতে এই গানের সঞ্চারীতে পৌঁছে যাওয়ার পর শাঁওলির চোখের জল ধরা পড়ে ক্যামেরায়। ক্যামেরা মিড ক্লোজ-আপ থেকে কাট শটে একেবারে এক্সট্রিম ক্লোজে ধরে শাঁওলির মুখ। চোখে জল স্পষ্ট। গানের লাইন তখন, 'শূন্য-পানে চেয়ে প্রহর গণি গণি/দেখো কাটে কিনা দীর্ঘ রজনী।' গানের তো একটা চলন থাকে। গীতিকার ইতিহাসের প্রশ্ন থেকে ক্রমে অপ্রাপ্তি শেষে একটা রিজেকশনের পথে যান। 'দুঃখ জানায়ে কী হবে, জননী, নির্মম চেতনাহীন পাষাণে।।' এখানেই শিল্পী ঋত্বিক-শাঁওলি জুটি ধূমকেতুর মতো অতিক্রম করে যান রবীন্দ্রনাথকে। অন্য মার্গে বোধহয় হাত ধরেন জীবননান্দ দাশের। গান শেষ হওয়ার পর শাঁওলি কান্নায় ভেঙে পড়েন ঋত্বিকের বুকে। যে আশ্রয়ের সন্ধানে ছবির শুরু থেকে এঁদের যাত্রা শুরু, সেই আশ্রয়ের ভাঙা বাড়িতে যেন স্থান হয় শাঁওলির। লক্ষ্য করুন, গানের কথা মিথ্যা হয়ে যায়। অশ্রু নিভৃত থাকে না, শাঁওলি ক্রমে হয়ে ওঠেন আমার মা।

advertisement

আরও পড়ুন - বাংলা নাট্যজগতে নক্ষত্রপতন, প্রয়াত শাঁওলি মিত্র! নীরবতায় শেষ বিদায়...

জীবনানন্দ সোনার বাংলার রূপ দেখেছিলেন, ঋত্বিক দেখেছিলেন ভাঙা বাংলার মুখ। মাতৃজঠরফেরত দুই সন্তানের দুই বাংলা। যেন একই মায়ের দুই সন্তান, একটি একটু বেয়াড়া, একটি আবার লক্ষ্মীটি। কিন্তু এর মধ্যেই থেকে প্রতিমার শেষ-তম রূপ হয়ে ওঠেন শাঁওলি। আমারও মা আছেন, আপনারও আছেন। হয়ত তিনি এখনও শক্তসমর্থ। হতে পারে এই সংক্রান্তিতেও তিনি যত্নে বানিয়েছেন পিঠে, পায়েস। হয়ত এখনও জ্বর হলে তিনিই এগিয়ে দেন ওষুধ। হয়ত এখনও আপনার-আমার বাড়ি ফিরতে দেরি হলে তিনিই অপেক্ষা করেন রাস্তায়। হয়ত তিনিই এখনও সবার আগে সকালে ওঠেন ঘুম থেকে। হয়ত তিনিই বন্ধক দেন গহনা, হয়ত তিনিই আশীর্বাদ করেন, ঈশ্বরের কাছে পরিবারের মঙ্গলকামনা করেন। হয়তো আজ দুপুরেও, এই শীতের রোদ মেখে তিনি বসবেন বারান্দায়। নিয়ম করে চুল আঁচড়ে নেবেন। তারপর এক দিন চিরসত্য মৃত্যুর নিশ্চিন্ত জঠরে আশ্রয় নেবেন তিনিও। বিশ্বাস করুন, আমার মা এসেছিলেন যশোর থেকে। এসেছিলেন উদ্বাস্তু হয়ে। এসেছিলেন সব হারিয়ে। হাজার একটা মায়ের মুখে যেন আঁকিবুঁকি কাটে শৈশবের ছিটকে যাওয়া স্মৃতি, তেমনই আমার মায়ের মুখের জীর্ণতায় আশ্রয় করে নিয়েছে সেই দেশভাগের যন্ত্রণাও। ঠিক যেমনটা নিয়েছিল বঙ্গবালার মুখেও। শাঁওলির অন্দরেও কী কোথাও তাঁবু গেড়ে বসেছিল নিঃশব্দ বিচ্ছিন্নতা, অপার নৈঃশব্দ! তাই ফুলও ভারী মনে হল তাঁর। ভাঙা বাংলার প্রতিটি মায়েরও কি এ ভাবেই ভারী মনে হয় ফুল? তাঁরা কি সকলেই এমন নিঃশব্দে, শীতের বারান্দা খালি করে দিয়ে চলে যেতে চান? কাউকে না জানিয়ে?

সেরা ভিডিও

আরও দেখুন
লালগোলাতে রাজরাজেশ্বরী রূপে পূজিতা হন মা কালী! দেওয়া হয় ইলিশের ভোগ
আরও দেখুন

আহ্, শিল্পী যে কেন অমর হয় না!

বাংলা খবর/ খবর/বিনোদন/
Shaonli Mitra: 'কেন চেয়ে আছ, গো মা'; শাঁওলি, রবীন্দ্রনাথ ও ঋত্বিক
Open in App
হোম
খবর
ফটো
লোকাল