ভারত বিখ্যাত সংগীত পরিচলক শান্তনু মৈত্র ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের উদ্যোগে ও সহজিয়া ফাউন্ডেশনের সহায়তায়, ‘গুরু-শিষ্য পরম্পরা’র শ্রী-খোল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের গুরু হিসেবে ছিলেন গত এক বছর। তিলক মহারাজ বর্ধমান স্টেশন থেকে ৩০ কিমি দূরে বনপাশ মোহনপুরে, একটি গ্রামীণ শ্মশানপ্রান্তে কালী মন্দির সংলগ্ন আশ্রমে থাকতেন। সেখানে তিনিই শ্মশানযাত্রীদের শেষকৃত্যে সহায়তা করতেন আবার তিনিই তান্ত্রিকাচারে মায়ের নিত্য পুজোও করতেন। এই ‘শ্মশানবাসী’ বাংলার লোকসাধকদের একটা বিলুপ্তপ্রায় সম্প্রদায়। গত ৩ এপ্রিল তাঁর বর্ণময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
advertisement
সহজিয়া ফাউন্ডেশনের আয়োজনে গত ১৭ নভেম্বর বিকেলে রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তিলক মহারাজের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ‘একাদশ সহজিয়া উৎসব’। উপস্থিত ছিলেন – সর্বশ্রী দেবদাস বাউল, মনসুর ফকির, গৌতম দাস বাউল, স্বপন বসু, তন্ময় বসু, হিরণ মিত্র, অনিন্দ্য – উপল (চন্দ্রবিন্দু), সিধু (ক্যাকটাস), মনোময়, হৃদিস্রোতা, ঋষভ, স্বর্ণাভ, নাজমুল, শোভনসুন্দর, মৌনীতা, সহজ সুরের পাঠশালা প্রমুখ।
অনুষ্ঠান শুরু হয় প্রবীণ শিল্পী শ্রী দেবদাস বাউলের আসর বন্দনা দিয়ে। এরপর ছিলেন উমারাণী দাস ও গৌতম দাস বাউল। সিধু ও দেবের যৌথ নিবেদন ‘মুর্শিদ ধন হে’ এবং উপল ও অনিন্দ্যর ‘টাপা টিনি’ অনুষ্ঠানের মূল সুর বেঁধে দেয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল সহজিয়ার কর্ণধার এবং জি-বাংলা সারেগামাপা র মেন্টর দেব চৌধুরীর পরিচালনায় ‘সহজ সুরের পাঠশালা’র ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গীত-কোলাজ যা সদ্য প্রয়াত বাউলগুরু সাধনদাস বৈরাগী, ঝুমুরিয়া সুভাষ চক্রবর্তী ও মহীনের ঘোড়াগুলির তাপস বাপি দাসের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত।
দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয় শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্য্যের এই নিবেদন ‘আমার গহীন জলের নদী’ ও স্বপন বসুর ‘কান্দিয়া আকুল হইলাম ভব নদীর পারে’। স্বর্ণাভ, হৃদিস্রোতা আর ঋষভ জি-বাংলা খ্যাত এই তিন বিস্ময়কর খুদে প্রতিভা দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিল। উৎসবের এক বিরল মুহূর্ত পন্ডিত তন্ময় বোসের কন্ঠে পরিবেশিত একটি মহাজনী গান। রাগ সঙ্গীত ও লোক সঙ্গীত, এই দুই ধারার সঙ্গীতই যে আদি এবং তারা পরস্পরের পরিপূরক তা তিনি গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন। সমগ্র দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানায়।
এবছর ‘সহজিয়া সম্মান’ পেলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শ্রী-খোল গুরু গোপাল বর্মণ ও গিটার গুরু শ্রী টুটুল গঙ্গোপাধ্যায়। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ এক দারুণ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল যখন টুটুল গাঙ্গুলি তাঁর ছাত্র ঋষভের গানের সঙ্গে গিটারে সঙ্গত করেন এবং তিলক মহারাজকে তারই বাদ্যযন্ত্র শ্রীখোলের একক বাদ্যে সম্মান জানালেন শ্রী গোপাল বর্মণ। মনসুর ফকিরের মিলনগীতি দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি হয়। কলকাতার সঙ্গীতরসিক মানুষেরা এক বিরল সন্ধ্যার সাক্ষী হয়ে থাকলেন।