অনেকে আপত্তি তুলতেই পারেন! বলতে পারেন যে রাপ্পা রায়ের সঙ্গে পরিচয় তাঁদের হালে নয়। কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। তবে যেহেতু ছবির রিভিউ, তাই নতুনত্বের স্বাদ যে দর্শক পাবেন, সেটাও মেনে না নিলে রীতিমতো অন্যায় হবে। কেন না, বাংলা ছবির গোয়েন্দাদের ভিড়ে রাপ্পা রায় এক নতুন নাম, পুরোপুরিই!
ছোটদের এক বিখ্যাত বাংলা পত্রিকায় সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাপ্পা রায় বহু বছর ধরে পাঠকের মন জয় করেছে। তৈরি করেছে বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দাদের ভিড়ে স্বতন্ত্র এক জায়গা। আর সেটাই এই ছবির আসল চ্যালেঞ্জ।
advertisement
কেন না, যখনই সাহিত্য উঠে আসে রুপোলি পর্দায়, তখন পাঠকের প্রত্যাশা সামান্য হলেও টাল খায়, তার নিজের কল্পনার সঙ্গে তা পুরোপুরি মেলে না। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও সপ্তপদী দেখে খুশি হননি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাল লাগেনি অরণ্যের দিনরাত্রি। এই দুই ছবির নাম বিশেষ করে উল্লেখ করার কারণ রয়েছে, সে প্রসঙ্গে যথাসময়ে আসা যাবে। এখন যা উল্লেখ না করলেই নয়- সাহিত্য আর রুপোলি পর্দার দ্বন্দ্ব দূরে সরিয়ে রেখে ছবি দেখা উচিত হবে, না হলে অন্যায় হবে।
বাংলা কমিক ক্যারেকটার রাপ্পা রায়ের যাত্রা বইয়ের পাতা থেকে রুপোলি পর্দায় হাজির হয়ে এক রোমাঞ্চকর ছবির প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০ বছরের শেষের দিকে বয়স, রাপ্পা রায় একজন প্রতিভাবান কার্টুনিস্ট। তিনি কলকাতায় তাঁর কঠোর কিন্তু একই সঙ্গে যত্নশীল বাবার সঙ্গে থাকেন। অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তিনি তদন্ত, ব্লগিং এবং ভ্লগিং-এর দিকে ঝুঁকে পড়েন, তাঁর শৈশবের বন্ধু টনির সাহায্যে চলে শহর জুড়ে সামাজিক সমস্যা, অপরাধ এবং দুর্ঘটনার নথিভুক্তিকরণ। তাঁর নির্ভীক এবং খাঁটি বিষয়বস্তু দ্রুত মনোযোগ আকর্ষণ করে সকলের, বিপদ ঘনিয়ে আসে যখন দুর্ঘটনাক্রমে ভয়ঙ্কর এক গোষ্ঠী ফুল স্টপ ডট কমের সঙ্গে সম্পর্কিত হিংসাত্মক কার্যকলাপও তিনি তুলে ধরেন।
হুমকির কাছে মাথা নত করতে বা তাঁর পোস্ট এবং প্রমাণ মুছে ফেলতে অস্বীকৃতি জানান রাপ্পা। আর নিজের অজান্তেই উদীয়মান অভিনেত্রী ডলফিন গঙ্গোপাধ্যায়কে বিপদে ফেলে দেন, দলটি তাঁকে টার্গেট করে। বাধ্য হয়ে রাপ্পা ডলফিনকে উদ্ধার করার জন্য দৌড়ে যান, নিজের সাহস, বুদ্ধি এবং টনির বন্ধুত্বের অটল বন্ধনের উপর নির্ভর করে যখন তিনি একটি নির্মম অপরাধী চক্রের মুখোমুখি হন।
ছবিটি পরিচালনা করেছেন ধীমান বর্মণ, প্রযোজনাও তাঁরই হাউজ ধীমান বর্মণ প্রোডাকশনসের। ছবিতে রাপ্পা আর টনির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অর্পণ ঘোষাল এবং দেবাশিস রায়। অন্য চরিত্রে দেখা গিয়েছে অলিভিয়া সরকার, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, সৌরভ দাস, সব্যসাচী চৌধুরি, প্রান্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজন নীল মুখোপাধ্যায়, রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস মণ্ডল, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, লিজা গোস্বামী, পূষণ দাশগুপ্ত প্রমুখকে।
এই ছবির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার তরতাজা লুক। নবীন আর প্রবীণেরা অনবদ্য ভাবে পরস্পরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন। টনির চরিত্রে দেবাশিস রায়ের কমিক টাইমিং আলাদা করে নজর কাড়বে। পাঠক বলতেই পারেন যে কমিকসের রাপ্পা রায় ছবির রাপ্পা রায়ের মতো এতটাও অন্তর্মুখী নয়, তবে চরিত্রে অর্পণ ঘোষালকে খুবই ভাল মানিয়ে গিয়েছে, তাঁর অভিনয় আরও এক রাপ্পা রায় ছবির ক্ষিদে তৈরি করে দেয়। রাপ্পার বাবার চরিত্রে বিশেষ করে নজর কেড়েছেন শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, তাঁর ক্ষুরধার, ব্যঙ্গাত্মক সংলাপ পরিবেশনা মন জয় করে নেয়, অন্য অভিনেতারাও যত্ন নিয়ে নিজেদের ভূমিকা পালন করেছেন।
শুধু একটি খুঁত দর্শককে কিঞ্চিৎ বিরক্ত করতে পারে, তা হল ছবির দৈর্ঘ্য। ছবি আরেকটু ঝরঝরে হলে ভাল হত। আছে আরও একটি বিষয়। সপ্তপদী, অরণ্যের দিনরাত্রির অবতারণা যে প্রসঙ্গে, সেটা না বললে অন্যায় হবে। সাহিত্য থেকে যখনই ছবি হয়, পরিচালক নতুন কিছু যোগ করেন, যা অনেকের ভাল নাও লাগতে পারে। রাপ্পা রায় অ্যান্ড ফুল স্টপ ডট কম-এর ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে, গল্প কমিকসের মতো হুবহু এক নয়, মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় সৃজনশীল স্বাধীনতা নিয়েছেন পরিচালক। সেটাও ছবি বড় হওয়ার একটা কারণ তো বটেই!
তবে, ধীমান নতুন পরিচালক, প্রথমবারেও তিনি যা নিয়ে এসেছেন দর্শকের কাছে, তা মন জয় করার পক্ষে কম কিছু নয়। যে ভাবে যত্ন নিয়ে পরিচালক এবং দল ছবির প্রতিটি ফ্রেম সাজিয়েছেন, সঙ্গীত প্রয়োগ করেছেন, তা ঝকঝকে এক লুক অ্যান্ড ফিল দেয়। আর ছোটদের দেখার মতো ছবি এখন বড় একটা হয় না, সেটাও ধীমানের কাছ থেকে এক বড় পাওনা, স্বীকার না করলে অন্যায় হবে। সব মিলিয়ে, ছোট এবং বড়- সবারই ভাল লাগবে রাপ্পা রায় অ্যান্ড ফুল স্টপ ডট কম।
