পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর আশ্বাস, তাঁর ছবির মূল চরিত্রের নাম ক্ষুদিরাম চাকী হলেও সেটা কোনওভাবেই বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু বা প্রফুল্ল চাকীর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়৷ রাজের মতে, যে কোনও নাম যে কারওর হতে পারে৷ তাঁর অভিযোগ, কিছু মানুষজন, বিশেষ করে বিজেপি-র আইটি সেল চেষ্টা করছে এর সঙ্গে ক্ষুদিরাম বসুর প্রসঙ্গ জুড়ে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার করতে৷ রাজের আরও সংযোজন, ‘‘যাঁরা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বঙ্কিমদা বলেন, যাঁরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙেন, যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে অসম্মান করেন, তাঁদের প্রোপাগান্ডায় পা দেবেন না৷ আমরা বাঙালিরা মহাপুরুষদের সম্মান করতে জানি৷ জ্ঞানত তাঁদের অসম্মান করব না৷ এটা হতে পারে না৷’’
advertisement
রাজ চক্রবর্তীর সাফাইকে নস্যাৎ করে রুদ্রনীল ঘোষের দাবি, ‘‘অহেতুক রাজ চক্রবর্তী বিজেপিকে এক্ষেত্রে টেনে আনলেন। আসলে এটা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ যুবভারতীতে মেসি-কাণ্ড থেকে শুরু করে রাজের ছবিতে ক্ষুদিরামকে অপমান-সব ক্ষেত্রেই তারা বিজেপির দোষ দেখতে পাচ্ছেন।’’ রুদ্রনীল মনে করেন এক্ষেত্রে বিষয়টিকে রাজ চক্রবর্তীর রাজনীতির রং দেওয়া উচিত হয়নি।
কিন্তু যাঁর মুখে এই সংলাপ টিজারেই ঝড় তুলেছে, সেই শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় কী বলছেন? তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন এই বিতর্কে কোনও মন্তব্য করবেন না৷ সত্যি কি অভিনেতার কোনও দায় থাকে সংলাপের ক্ষেত্রে? মানসী সিনহা বলছেন, অবশ্যই থাকে৷ পরিচালক তথা বলিষ্ঠ অভিনেত্রীর দাবি, তাঁর কাছে এরকম কোনও চিত্রনাট্য এলে তিনি প্রথমেই জানতে চাইতেন এই সংলাপের মানে কী৷ জিজ্ঞাসা করতেন কেন তিনি এই সংলাপ বলবেন৷ মানসীর ধারণা, যিনি সংলাপ লিখেছেন তাঁর মাথায় আসেনি শহিদ ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকীর আত্মত্যাগ কতটা গর্বের৷ যদি আসত, তাহলে এই সংলাপ তৈরি হত না৷ তিনি মনে করেন পরিচালক এবং শিল্পী দু’জনেরই দায় বা দায়িত্ব আছে এ ক্ষেত্রে৷ শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের নাম না করে মানসীর কটাক্ষ, ‘‘দায়িত্ববান অভিনেতাকে দেখে সাধারণ মানুষ শেখে৷ এই সংলাপ উচ্চারণ করা বা না করার ক্ষেত্রে তাঁর দায়িত্ব থেকেই যায়৷’’ ‘এটা আমাদের গল্প’-র পরিচালকের আক্ষেপ, ক্ষুদিরামের ‘ঝোলা’ এবং এই চিত্রনাট্যের ‘ঝোলা’-র মধ্যে যে পার্থক্য আছে, সেটাই উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে৷
প্রসঙ্গত মানসী সিনহা পরিচালিত ‘এটা আমাদের গল্প’-র নায়ক ছিলেন শাশ্বতই৷ তাঁর মুখে বিতর্কিত সংলাপের তীব্র নিন্দা করলেও এক বিন্দুতে মানসীর থেকে অন্যমত পোষণ করেন অভিনেতা রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাঁর মতে, অভিনেতাদের যা বলতে বলা হয়, তাঁরা সেটাই বলেন৷ এই সংলাপের দায়িত্ব সম্পূর্ণ পরিচালকের৷ তাঁর আরও সচেতন ও দায়িত্ববান হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন রাহুল৷ তিনি টেনে আনেন প্রচলিত ‘বার খেয়ে ক্ষুদিরাম হওয়া’-র মতো প্রচলিত কথারও৷ তাঁর খেদ, অতীতে এই শব্দবন্ধ উচ্চারণ করে আসা বাঙালি তাদের ভুল সংশোধন করতে পারল না৷ বাঙালির চিন্তা চেতনার সামগ্রিক অংশ মনীষীদের প্রসঙ্গে সংলাপ নিয়ে আরও অনেক সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে মত অভিনেতার৷
এই সংলাপ মানতে পারছেন না নাট্যব্যক্তিত্ব চন্দন সেনও৷ তিনিও রাহুলের সঙ্গে সহমত৷ ‘বার খেয়ে ক্ষুদিরাম’-এর মতো শব্দবন্ধ আদতে সমাজে ডেকে আনে আরও বড় বিপদ৷ বর্ষীয়ান শিল্পীর কথায়, ‘‘আমরা যারা অভিনয় করি তাঁরা জনমত, জনরুচি তৈরি করি কিছুটা হলেও৷ শিল্পীদের একটা অতিরিক্ত দায় থেকে যায়৷ সেই দায় সম্পর্কে সচেতন না হয়ে শুধু ব্যবসায়িক বৃত্তির দিকে নজর দিলে বার খেয়ে ক্ষুদিরাম শব্দবন্ধের মতো কুফলই মিলবে৷’’ শিল্পীর দায়বদ্ধতা থেকে সরে গিয়ে এই সংলাপ অত্যন্ত অসংবেদনশীল বলে মনে করে তিনি৷
প্রসঙ্গত ‘হোক কলরব’ শব্দবন্ধের জন্ম ১১ বছর আগে। ২০১৪ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তাঁর একদল সহপাঠীর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনেছিলেন। অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সে সময়ে তাঁর অভিযোগকে সম্যক গুরুত্ব দেননি। যার জেরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আর পড়ুয়াদের একটা বড় অংশ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ক্রমে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজ্য ছাড়িয়ে গোটা দেশে, হ্যাশট্যাগ ‘হোক কলরব’ নাম নিয়ে। সেই নামেই রাজের ছবির টিজারের বিতর্কিত সংলাপ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে চাননি শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তবে এই বিতর্কের ঝড়েও পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর দাবি, এর সঙ্গে শহিদ ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকীর কোনও সংযোগ বা সম্পর্কই নেই৷ তাঁর আশ্বাস, পরবর্তীতে প্রয়োজনে তিনি আরও বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলবেন৷ দরকার হলে বিতর্কিত সংলাপ তিনি বাদ দেবেন৷
