মাঝে বছর সাতেক পেরিয়ে গেলেও ঘোতন কিন্তু এখনও এই কেজো পৃথিবীর কাছে রয়ে গিয়েছে ‘হাবাগোবা’ হয়েই৷ কলকাতার বদলে এখন তার ঠিকানা আকাশগঞ্জ৷ সে জায়গার নামে আকাশ, কাজেও আকাশ৷ কবে যেন আকাশ থেকে নেমে এসে সেখানে ডিম পেড়ে গিয়েছিল পক্ষীরাজ৷ সেই ডিম অনেক অনেক বছর ধরে রাখা আছে ভিনগ্রহীদের যানের মতো দেখতে এক মন্দিরে৷ সেই মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে জটিল আঁক কষা আছে৷ আধপাগলা সাপরাজ বাবা সেখানে কাউকে ঢুকতে দেন না৷
advertisement
এদিকে ঘোতনের খুব ইচ্ছে ওই মন্দিরে ঢুকে পক্ষীরাজের ডিম স্বচক্ষে দেখার৷ কিন্তু ইচ্ছেপূরণের পথে বিধিবাম৷ সে মাধ্যমিকের সিলেকশন টেস্টে অঙ্কে শূন্য পেয়ে বসে আছে! হেডমাস্টার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন অঙ্কের বটব্যাল স্যর অনুমতি না দিলে কোনও রিটেস্ট নেওয়া হবে না তার৷ সেই অনুমতি দেওয়ার আগে বটব্যাল স্যর নিজেই স্কুল থেকে টিসি পেয়ে বসলেন! অসম্ভব প্রতিভাবান এই শিক্ষক গত ধরা পথে বিজ্ঞান পড়াতে চান না৷ সেই ছক ভাঙা খামখেয়ালিপনায় জেরবার হয়ে প্রধানশিক্ষক তাঁকে খারিজ করেছেন৷
আরও পড়ুন : কর্পোরেট অফিস সুখের হয়…কেমন হল শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ছবি ‘আমার Boss’? পড়ুন রিভিউ
চাকরি হারিয়ে বটব্যাল স্যর মন দিয়েছেন নিজের আবিষ্কারে৷ বিজ্ঞানসাধনার জন্য আততায়ীর কাছে প্রাণ হারানো বাবার অসম্পূর্ণ কাজ তিনি শেষ করতে চান৷ ওদিকে ঘোতনের বাবাও ছিলেন বিজ্ঞানী৷ তিনিও চেয়েছিলেন ঘোতন যেন বড় হয়ে বড় বৈজ্ঞানিক হয়৷ সেই স্বপ্নপূরণ তো দূর অস্ত্৷ ঘোতন নিজে অঙ্কেই গোল্লা৷ এখানেই সুনিপুণভাবে শীর্ষেন্দুকে ছবিতে মিশিয়েছেন সৌকর্ষ৷ বুরুনকে যেমন সব সময় গোঁসাইবাগানের ভূত সব সময় মনে করিয়ে দিত-বুরুন, তুমি অঙ্কে ১৩, ঘোতনকেও তার ব্যর্থতা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভিডিও কলে বলে চলে পপিন্স৷ ছোট্টবেলার প্রেম পপিন্স আজ মুম্বইয়ের কলেজে পড়তে যাওয়ার পথে৷ ওদিকে তার ঘোতনদাদা এখনও মাধ্যমিকই পাশ করতে পারল না!
কী হবে ঘোতনের? ফেল করেও সে পারবে বড় বিজ্ঞানী হতে? বটব্যাল স্যার রাজি হবেন তাঁকে অঙ্ক শেখাতে? রিটেস্টের অনুমতি দেবেন তিনি? পপিন্স কি ঘোতনকে ছেড়ে মুম্বই চলেই যাবে? সবথেকে বড় প্রশ্ন হল, দিনের শেষে পক্ষীরাজের ডিম কে পাবে খুঁজে? লোভী বিদেশির নজর থেকে তাকে বাঁচানো যাবে? সে সব প্রশ্নের উত্তর পেতে দেখতেই হবে রূপকথা আর কল্পবিজ্ঞানের পাকে জারিয়ে নেওয়া অনবদ্য ছবি ‘পক্ষীরাজের ডিম’৷ টালিগঞ্জে ‘পাতালঘর’-এর পর ফের এত উপভোগ্য, জমজমাট কল্পবিজ্ঞাননির্ভর ছবি এল৷ কোথাও কোথাও এ ছবি যেন ছাপিয়ে গিয়েছে পূর্বসুরি ‘রেনবো জেলি’-কেও৷
কুশীলবদের অভিনয়, কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্যের যোগ্য সঙ্গত করেছে ছবির লোকেশন এবং দৃ্শ্যায়ন৷ সৌমিক হালদারের লেন্সে বাঙালির আদি অকৃত্রিম পশ্চিম-শিমুলতলা যেন ধরা দিয়েছে অদ্ভুতুরে সিরিজের কোনও সাকিন হয়েই৷ শিমুলতলার লাট্টু পাহাড়, নলডাঙার জমিদারের বাড়ি, গোলাপবাড়ি, ঢেউ খেলানো ছোটনাগপুর মালভূমির সর্পিল পথ বড় স্বপ্নালু এ ছবিতে৷ সেই স্বপ্নকে সাবানজলের বুড়বুড়ির মতো স্ক্রিন পেরিয়ে দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে ঘোতনের ভূমিকায় মহাব্রত বসু এবং পপিন্সের চরিত্রে অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মহাব্রত পর্দায় থাকলে অন্য কারওর দিকে নজর যাওয়া ভার৷ এত সাবলীল, সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত, যে তার উপস্থিতি সমানে পাল্লা দিয়ে গিয়েছে অনির্বাণ ভট্টাচার্যর সঙ্গে৷ বটব্যাল স্যরবেশী অনির্বাণ তাঁর অনস্ক্রিন এবং অফস্ক্রিন প্রতিভার মতোই দীপ্ত৷ বাকিদের মধ্যে দেবেশ রায়চৌধুরী, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়, অ্যালেক্স ও’ নিল এবং শ্যামল চক্রবর্তী যথাযথ৷ দেবেশ এবং অনুজয়ের অভিনয়ের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল চরিত্রোপযোগী নিখুঁত বাচনভঙ্গি ও উচ্চারণ৷ যা এখন বাংলা ছবিতে আরও অনেক কিছুর মতোই বিরল৷
আরও পড়ুন : মগনলাল মেঘরাজের মুলুকে কেমন হল একেনবাবুর অভিযান? পড়ুন ‘The একেন-বেনারসে বিভীষিকা’-র রিভিউ
তবে কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে দর্শকমনের খচখচানি একটু কমত৷ বটব্যাল স্যরের বিজ্ঞানসাধক বাবাকে কে বা কারা হত্যা করল? তার গবেষণা চুরি করতে কারা হানা দেয়ে মাঝে মাঝে? আকাশগঞ্জের অসাধু গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান কি সত্যি জব্দ হল? বিল্টু কি তার অপকর্মের শাস্তি পেয়ে গ্রামছাড়া হল? সাপরাজ বাবার অতীত ইতিহাসও একটু জানা গেলে ভাল হত৷ এ ছাড়া বাকিটা যাকে বলে ফাসক্লাস! যেখানে জীবনের আকাশে ডানা মেলে পক্ষীরাজ হয়ে উড়ে যেতে পারে ঘোতনের মতো টাট্টু ঘোড়াও৷ তার ভাল নাম ‘সার্থক’-এর মানমর্যাদা রাখতে৷ যদি পাশে থাকেন বটব্যালের মতো কোনও অঙ্কস্যার আর পপিন্সের মতো একজন গোলাপিবাবু৷ মাক্কালী!