পরিচালক- সঞ্জয় লীলা বনসালি
অভিনয়ে: আলিয়া ভাট, অজয় দেবগন, সীমা পাহওয়া এবং বিজয় রাজ
বলিউডের তথাকথিত ‘হ্যাপি এন্ডিং’-এ বিশ্বাস করেন না পরিচালক সঞ্জয় লীলা বনসালি (Sanjay Leela Bhansali)। সম্পর্কের চড়াই উৎরাই, রাগ, আক্রোশ, বার বার ভেঙে যেতে যেতে মুষড়ে পড়া মানুষ, ক্ষোভে দিগ্বিদিক রহিত মানুষ, প্রেমে পাগল হয়ে যাওয়া চরিত্রদের নিজের সিনেমায় নিজস্ব স্টাইলেই সাজান সঞ্জয় লীলা (Gangubai Kathiawadi Movie Review)। পদ্মাবৎ সিনেমায় আলাউদ্দিন খিলজি হোক বা বাজিরাও মাস্তানির মাস্তানি অথবা ব্ল্যাক সিনেমার মিশেল ম্যাকন্যালি, গঙ্গা হরজীবনদাস কাথিয়াওয়াড়ি বা গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়িও (Gangubai Kathiawadi) এই ঘটমান চরিত্রদের সারিতে এক অনবদ্য নাম।
advertisement
ট্রেলারেই গাঙ্গুবাইকে (Gangubai Kathiawadi Movie Review) বলতে শোনা গিয়েছিল, “কেহতে হ্যায় কামাথিপুরা মে কভি আমাবাস কি রাত নেহি হোতি। কিঁউকি ওয়াহা গাঙ্গু রেহতি হ্যায়! অউর গাঙ্গু চাঁদ থি অউর চাঁদ রহেগি”। গাঙ্গুবাইয়ের চরিত্র বুঝতে গেলে এই শব্দমালাই যথেষ্ট! রেট্রো কামাথিপুরার ঘোলাটে পতিতালয়ে সাদা শাড়িতে গাঙ্গু আলিয়া ভাট (Alia Bhatt) সত্যিই চাঁদ। তাঁর জ্যোৎস্নায় উজ্জ্বল সঞ্জয় লীলার গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি। এস হুসেন জাইদি এবং জেন বোর্হেসের লেখা বই ‘মাফিয়া কুইন্স অফ মুম্বই’ (Mafia Queens of Mumbai) অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমাটি অপরাধী, ডন এবং যৌনকর্মী গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ির জীবনকেই বড় পর্দায় লিখেছে। ষাটের দশকে মুম্বইতে যৌন সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী থেকে সমাজকর্মী ও মাফিয়া হয়ে ওঠার গাঙ্গুবাইয়ের যাত্রাপথের গল্পের শুরুটা চেনাই।
ভারতের নিম্নবিত্ত প্রান্তিক অল্পবয়সী মেয়েদের অনেকেরই প্রেমে পড়ে যা পরিণতি, গাঙ্গুরও তাই। হিন্দি সিনেমায় নায়িকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করে প্রেমিকের সঙ্গে বম্বেতে চলে আসা। নায়িকা হওয়া হয় না, হয় প্রেমিকাকে বেচে দেওয়া। পতিতালয়ে বিক্রি হয়ে যাওয়া গাঙ্গুবাই বোঝে এ এমন এক গোলকধাঁধা, যেখান থেকে বেরনোর পথ নেই। অগত্যা ভাগ্যকে তাড়াতাড়ি মেনে নিতে পারলেই স্বস্তি। এক বছরের মধ্যেই পতিতালয়ে নিজের জায়গা করে নেয় গাঙ্গু, সহকর্মীদের, বোনদের মন জয় করে আলিয়ার গাঙ্গু (Gangubai Kathiawadi Movie Review)।
কিন্তু গাঙ্গু তো চাঁদ, তার নিজস্ব আলোয় খুব অন্ধকারেও পথ খুঁজে পেতে পারে পথিক। গাঙ্গুবাইয়ের নেতৃত্ব এবং দাপটে কেবল যৌনকর্মী হয়েই থেকে যায় না সে, স্থানীয় গ্যাংস্টার করিম লালার সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে। করিম লালার চরিত্রে অজয় দেবগনের দুর্দান্ত অভিনয় বহুকাল পরে মন কেড়েছে।
সঞ্জয় লীলার সিনেমা মানেই কিং সাইজ চলচ্চিত্রায়ণ। উৎকর্ষিণী বশিষ্ঠ এবং বনসালির চিত্রনাট্য একটা সুর ধরার চেষ্টা করেছিল প্রথম থেকেই যাতে গাঙ্গুবাইকে পড়তে, বুঝতে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারেন দর্শকরা। কিন্তু প্রথমার্ধের শেষ থেকেই সেই সুর যেন কাটতে শুরু করে। গাঙ্গুবাইয়ে (Gangubai Kathiawadi Movie Review) বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই যেন পর্যাপ্ত সিনেম্যাটিক উপাদানের অভাবে ধুঁকতে থাকে চিত্রনাট্য। যদিও ক্লাইম্যাক্সের সময় সেই হারানো সুর কিছুটা ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন সঞ্জয় লীলা বনসালি। আসলে গাঙ্গুবাইকে মূলে রাখতে গিয়ে বাকি চরিত্রদের উপর সামান্য হলেও অবহেলা করেই ফেলেছেন পরিচালক।
আরও পড়ুন- সোমবার তিলোত্তমা মজল আলিয়া-য়, কলকাতায় 'গঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি'-র নতুন গান লঞ্চ
অভিনয় নিয়ে কথা বলতে গেলে আলিয়া ভাটকে সেলাম জানিয়েই শুরু করতে হয়। পর্দায় গাঙ্গুবাইয়ের চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলেননি আলিয়া, বরং নিজেই হয়ে উঠেছেন গাঙ্গুবাই। চোখ, মুখ এবং শরীর দিয়ে অভিনয়কে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন আলিয়া সেই দাপট এই বয়সের অভিনেত্রীদের মধ্যে কমই থাকে। চোখ সরানো যায় না আলিয়ার থেকে। গাঙ্গুবাই কোনও সাদা চরিত্র নয়, ধূসর ক্ষেত্র পরিপূর্ণ তাঁর জীবনের ছত্রে ছত্রে। তবে আলিয়া নিজের ঔজ্জ্বল্যে দর্শকদের শেষ অবধি গাঙ্গুবাইয়ের অবধি চরিত্রটিকে এক মুহূর্তের জন্যও ফিকে হতে দেননি।
সিনেমায় একটি দৃশ্য রয়েছে যেখানে আলিয়া ১২ বছর পর বাবা মাকে ফোন করে জানতে পারে যে বাবা মারা গেছেন এবং টেলি অপারেটরের যখন জানায় আর তিরিশ সেকেন্ড বাকি আছে ফোনে কথা বলার, সেই মুহূর্তে অসহায়তা, রাগ, ঘৃণা মিশিয়ে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন আলিয়া তা অত্যন্ত সৎ। যৌনকর্মী এবং তাঁদের সন্তানদের অধিকারের লড়াইকে তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিটি শব্দের উচ্চারণে দাপট আলিয়াকে নিজের অভিনয় জীবনে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে বলাই যায়।
আরও পড়ুন- 'গাঙ্গুবাই কাথিওয়াড়ি'-তে আলিয়াকে দেখে অবাক ভিকি! বাড়ি ফিরেই ছবির রিভিউ দিলেন
স্থানীয় গ্যাংস্টার হিসাবে অজয় দেবগন দুর্দান্ত, সীমা পাহওয়াও অনবদ্য। এছাড়াও কমলি চরিত্রে ইন্দিরা তিওয়ারি, আফসানের চরিত্রে শান্তনু মহেশ্বরী নজর কেড়েছেন। রূপান্তরকামী রাজিয়াবাইয়ের ভূমিকায় বিজয় রাজ অভিনয় করেছেন, গাঙ্গুবাইয়ের বিপরীতে এমন একজন চরিত্রকে নিয়ে আরেকটু যত্নশীল হওয়া যেত বলেই মনে হয়।
গাঙ্গুবাই সিনেমার গতি মন্থর, মাঝে মাঝেই মনে হতে পারে বিক্ষিপ্ত চিত্রনাট্য। তবে সঞ্জয় লীলা বনসালি আর আলিয়া ভাটের জুটির প্রথম এই সিনেমা শুধু গাঙ্গুবাই চরিত্রটির জন্যই দেখা উচিত। সময়টা ষাটের দশক, জায়গাটা ভারতবর্ষের যৌনপল্লী। একজন যৌনকর্মী মহিলার সমাজকর্মী বা গ্যাংস্টার হওয়া কোনওটাই সহজ নয়।