‘‘খুব ভাল গান গাইত অর্পণ দা..ভরাট গলা৷ খুব ভাল ছবিও তুলত৷ ছবি তোলা, স্পেসিমেন প্রিসার্ভ করা, ট্যাক্সোনমিক আইডেন্টিফিকেশন করা, হাতে ধরে শেখাত আমাদের৷ এত বড় বয়সে এসে এমন বন্ধু, এমন শিক্ষক ক’জনই বা পায় ৷’’ কথাগুলো বলতে বলতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক পার্থিব বসুর স্কলার অদিতি দত্তর গলা থিতিয়ে আসছিল৷ যেন বহু দীর্ঘ এক যাত্রার এখানেই শেষ৷ এখানেই স্বস্তি৷ এটাই প্রাপ্তি৷ ভারত ভূখণ্ডে পাওয়া এক নতুন মৌমাছির নামকরণ হল তাঁরই ল্যাবের ‘সিনিয়র দাদা’ তথা ভারতীয় বিজ্ঞানের এক প্রয়াত ছাত্র অর্পণ পাড়ুইয়ের নামে৷ দিনের পর দিন মাঠে ঘাটে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ভারতীয় গবেষকদের আবিষ্কার স্বীকৃতি পেল বিশ্ব দরবারে৷ ‘‘জীবন মরণের’’ সীমানা ছাড়িয়ে চিরকালের জন্য নিজের ভালবাসার-ভাললাগার ছোট্ট ‘দুনিয়া’য় নিজের নাম রেখে যেতে পারলেন অর্পণ পাড়ুই৷
advertisement
ভারত ভূখণ্ডে প্রথম রেকর্ডেড ক্যাম্পটোপিয়াম জেনাসের মৌমাছির নতুন পাওয়া স্পিসিসের নামকরণ হল ড. অর্পণ পাড়ুইয়ের নামে৷ পৃথিবীতে নতুন পাওয়া এই মৌমাছি, বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘নিউ টু সায়েন্স’, নামাঙ্কিত হল ক্যাম্পটোপিয়াম পাড়ুই (Camptopoeum paruii)৷ সেই মৌমাছির বিশদ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে ‘জার্নাল অফ ন্যাচরাল হিস্ট্রি’ নামের বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যার গবেষণাপত্রে৷ এই প্রকৃতির মৌমাছিরা সাধারণত একলা থাকে (সলিটারি বি), চাক বানায় না, মাটিতে বাসা করে৷
বর্তমান পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মৌমাছির ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা এখন প্রত্যেকেরই জানা৷ বিশেষ করে যখন ক্রমশই কমে আসছে মৌমাছির সংখ্যা৷ সেই মৌমাছি নিয়েই নিজের গবেষক জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক পার্থিব বসু৷ তাঁরই অভিভাবকত্বে পশ্চিমবঙ্গের পড়শি রাজ্য ওড়িশায় একটি গবেষণামূলক প্রকল্পের কাজ চলছিল৷ সেই প্রকল্পের কাজ চলার সময়ই ২০১৪ সালের এপ্রিলে ওড়িশার কুলডিহা ফরেস্টের কাছে কেলামারা এবং জলেশ্বরে গোবর্ধনপুর থেকে আরও অসংখ্য মৌমাছির সঙ্গে দু’টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়৷ সেই সমস্ত নমুনার চিহ্নিতকরণ অর্থাৎ ট্যাক্সোনমিক আইডেন্টিফিকেশন করার সময়েই সামনে আসে এক অদ্ভুত ব্যাপার৷
গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক তথা পার্থিব বসুর প্রাক্তন ছাত্র ড. সুপ্রতিম লাহা বলেন, ‘‘মৌমাছির নমুনার ট্যাক্সোনমিক আইডেন্টিফিকেশন করতে গিয়েই অর্পণ দা, অদিতি এবং আমি বুঝতে পারি, এই মৌমাছি দু’টি কোনও ভাবেই চিহ্নিত করা যাচ্ছে না৷ এর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য প্রচলিত কোনও মৌমাছির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলছে না৷ পৃথিবীতে ক্যাম্পটোপিয়াম জেনাসের ৩১-৩২টি স্পিসিস রয়েছে৷ তার মধ্যে কারও বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেই আমাদের পাওয়া মৌমাছির বৈশিষ্ট্য মিলছিল না৷ এটা একদম আলাদা ছিল৷’’
মাইক্রোস্কোপের চোখে নতুন আবিষ্কৃত মৌমাছি। ক্যাম্পটোপিয়াম পাড়ুই (Camptopoeum paruii)
সত্যিই কি আলাদা ছিল? বিষয়টি বুঝতে তাঁরা প্রকল্পের সিনিয়র ট্যাক্সোনমিস্ট স্টুয়ার্ট রবার্টকে নমুনার ছবি তুলে পাঠান৷ স্টুয়ার্টই প্রথম আন্দাজ করেন, সম্ভবত এই মৌমাছি, মৌমাছিদের দুনিয়ায় মানুষের নতুন আবিষ্কার৷ এরপরে, স্টুয়ার্টের পরামর্শমতো সেই মৌমাছির নমুনা দু’টি পাঠানো হয় বেলজিয়ামের ট্যাক্সোনমিস্ট সেবেস্টিয়ান প্যাটিনির কাছে৷ তিনি দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ শেষে জানান, হ্যাঁ, ভারতের ওড়িশায় পাওয়া এই মৌমাছি পৃথিবীতে সত্যিই নতুন আবিষ্কার৷
অদিতির কথায়, ‘‘এর মাঝেই ২০১৭ সালে অর্পণ দা মারা যান৷ তারপরে যখন এই মৌমাছির নামকরণের প্রসঙ্গ ওঠে, তখন স্যর (পার্থিব বসু), স্টুয়ার্ট এবং সেবেস্টিয়ান তিনজনেই এই মৌমাছির স্পিসিসের নাম অর্পণ দা’র স্মৃতিতে ‘পাড়ুই’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷’’
আরও পড়ুন: এটা পাকিস্তানের স্বভাব!…মুনির তো ঠিক আছে, পরমাণু হুমকি নিয়ে নয়াদিল্লির জবাব আমেরিকাকে
এরপরেও নানা কারণে এই আবিষ্কারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া থমকে ছিল৷ এর মাঝে ২০২৪ সালে আকস্মিকভাবেই চলে যান গোটা বিষয়টির মূল হোতা পার্থিব বসু৷ অদিতি জানান, শেষে সেবেস্টিয়ানের ছাত্র তথা ট্যাক্সোনমিস্ট থমাস উডের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় এই গবেষণাপত্র৷
সুপ্রতিমের কথায়, ‘‘এটা ঠিক যে, অর্পণ দা এবং স্যর এই স্বীকৃতি দেখে যেতে পারলেন না৷ তবুও কোথাও হয়ত মনে হচ্ছে, এটা তো আমরা ওঁদের দিতে পারলাম! জীবনের সব বৃত্তই সম্পূর্ণ হয়৷ এটাও হল৷ প্রায় ১০ বছর পর হলেও হল৷’’